বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্ব: সন্তানই কি কেবল নারীর পরিচয়?

বাংলাদেশে মা হওয়া শুধুই ব্যক্তিগত যাত্রা নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা, একটি মাইলফলক যা নারীর পরিচয় ও মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু যখন এই পথটি বন্ধ্যাত্ব বা সন্তান জন্ম ডিতে না পারার  কারণে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন প্রভাব কেবল হাসপাতালের দেয়াল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি নারীর সামাজিক মর্যাদা, আত্মমর্যাদা এবং মানসিক জীবনের গভীরে ছাপ ফেলে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী এর সংজ্ঞা সরল। বন্ধ্যাত্ব হল ১২ মাস নিয়মিত অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের পর গর্ভধারণে অক্ষমতা। বিশ্বব্যাপী, প্রায় প্রতি ছয়জন মানুষের মধ্যে একজন জীবনে অন্তত একবার বন্ধ্যাত্বের মুখোমুখি হয়। প্রায় ১৫% দম্পতি প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণ করতে পারে না, এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ নেই, তবে গবেষণা ও জরিপ বলছে যে প্রায় ১৫% প্রজননযোগ্য বয়সের নারী বন্ধ্যাত্বে ভুগছেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চতম হার। অন্যান্য অনুমান অনুযায়ী, দেশজুড়ে প্রায় ১০–১৫% দম্পতি কোনো না কোনো ধরনের বন্ধ্যাত্বের সম্মুখীন। সঠিকভাবে মূল্যায়ন করলে, পুরুষ ও নারীর উভয় উপাদানই বন্ধ্যাত্বে প্রায় সমানভাবে ভূমিকা রাখে।

তবুও, অনেক বাংলাদেশি নারীর বাস্তব জীবন কেবল পরিসংখ্যানের কথা নয়। এটি প্রতিদিনের বিচার, পারিবারিক সমাবেশে ফিসফিসে প্রশ্ন, এবং “অপূর্ণ” হিসেবে দেখার ভারসাম্য নিয়ে।

বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্ব প্রায়ই নারীর সমস্যা হিসেবে ধরা হয়, যদিও বাস্তবতা হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী বন্ধ্যাত্বের ৪০–৫০% ক্ষেত্রে পুরুষের অবদান থাকে। ফলস্বরূপ, নারীদের দায়ী করা হয়, তিরস্কৃত করা হয়, এবং লজ্জিত করা হয়। 

গবেষণা “Infertility and Assisted Reproduction as Violent Experiences for Women in Bangladesh: Arts‑based Intervention to Address GBV (Arts for I‑ARTs)” এই বাস্তবতা তুলে ধরেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদেরকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  দম্পতির গর্ভধারণে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়, চিকিৎসা পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেন। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব নিশ্চিত হলেও, অনেক পরিবার নারীদের চাপ দেয় নীরব থাকার জন্য, যাতে “পুরুষের মর্যাদা” রক্ষা হয় এবং পরিবারের সম্মান বজায় থাকে।

তাই পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য প্রায়শই খোলাখুলিভাবে আলোচনা হয় না, এমনকি  পুরুষদের পরীক্ষাই করতে বেশিরভাগ পরিবার ভয় পায়, আর চিকিৎসা তো দুরে থাক। 

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা এখনও বেশ কঠিন। IVF ও IUI-এর মতো সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি (ART) অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা অধিকাংশ পরিবারের নাগালের বাইরে। সীমিত জনসেবা, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের অভাব, এবং প্রজনন চিকিৎসায় নীতিগত সহায়তার অভাব রয়েছে। বহু নারী হাহাকার, ব্যয়বহুল প্রাইভেট ক্লিনিক, প্রচলিত ঔষধচর্চা, বা দীর্ঘদিনের ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে পড়েন, যেগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাফল্য দেয় না।

গ্রামীণ নারীরা আরও বড় বাধার মুখোমুখি হন। সীমিত সচেতনতা, পরিবহন খরচ, স্থানীয় বিশেষজ্ঞের অভাব, এবং পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা গ্রহণকে কঠিন, কখনও কখনও অসম্ভব করে তোলে। এমনকি যেখানে পরিষেবা আছে, সেখানে সচেতন সম্মতি ও সহায়ক পরামর্শ প্রায়ই নেই, যা চিকিৎসাকে আরও মানসিক চাপের উৎসে পরিণত করে।

স্টিগমা ও সামাজিক দায়িত্বহীনতা কখনও কখনও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার (Gender-based Violence) দিকে নিয়ে যায়। যেখানে নারীর মূল্য মাতৃত্বের সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে যুক্ত, সেখানে বন্ধ্যাত্ব হয় শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা, লজ্জা, বা ছেড়ে যাওয়া বা দ্বিতীয় বিয়ের হুমকির কারণ।

এই অবস্থা বদলাতে আমাদের প্রয়োজন শুধু ক্লিনিক ও প্রযুক্তি নয়। আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা। গোটা দেশের মানুষকে এটা বোঝানোটা জরুরি যে নারীরা শুধুই গর্ভধারণের সক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি। 

সূত্র:

১)  দ্যা ডেইলি স্টার

২) পাবমেড 

Leave a Reply