নোনাজলের নীরব শিকার: উপকূলীয় নারীদের বিপর্যস্ত  প্রজনন স্বাস্থ্য!

বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূল অঞ্চল যেন এক অন্তহীন সংগ্রামের নাম। লবণাক্ত জল, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আর দারিদ্র্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা এই অঞ্চল শুধুমাত্র প্রকৃতির সঙ্গে নয়, এই অঞ্চলের নারীরা তাদের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়েও এক অবিরাম যুদ্ধ করে চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের পানি যখন ধীরে ধীরে বাসযোগ্য বা আবাদযোগ্য এলাকায় ঢুকে পড়ে, তখন সেই নোনাজল শুধু চাষাবাদই নয়, নারীর প্রজননস্বাস্থ্যকেও নীরবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

উপকূলের বহু গ্রামে পরিষ্কার খাবার পানির অভাব আজও নিত্যদিনের সমস্যা। পানীয় ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত জলে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নারীরা নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন—প্রজনন সংক্রমণ, ত্বকের সমস্যা, এমনকি উচ্চ রক্তচাপ পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে। মাসিকের সময় নিরাপদ ও গোপনীয় পরিবেশের অভাবে মেয়েরা ও নারীরা অস্বাস্থ্যকর উপকরণ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, সেই সাথে যন্ত্রণাদায়ক মানসিক অস্বস্তি তো রয়েছেই।

সমস্যার আরেকটি ভিন্ন দিক হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা। এখনও অনেক পরিবারে মেয়েদের মাসিক নিয়ে কথা বলা লজ্জার বলে ধরা হয়। ফলাফল—তারা প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য, পণ্য বা চিকিৎসা কোনোটাই পায় না। অর্থনৈতিক কষ্টও তখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য স্যানিটারি প্যাড কেনার সামর্থ্যও অনেকের নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বন্যাকবলিত এলাকা সমূহের অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের জন্য আলাদা স্যানিটেশন বা গোপনীয় জায়গার ব্যবস্থাও থাকে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আইডব্লিউএফএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট) ও সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) তিনটি গবেষণা করেছে। প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। গবেষণাগুলোর ফলাফলে বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে, তাতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত বা লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিশেষ করে উপকূলের ৪টি জেলার ৮ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে উপকূলীয় জেলাগুলোর লবণাক্ততাও। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে উপকূলের প্রতিবেশ, মানুষের জীবনযাপন, কৃষি, ভূগর্ভস্থ পানি ও অবকাঠামোর ওপর। আইডব্লিউএফএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের এ উচ্চতা বৃদ্ধি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এ কারণে উপকূলের প্রতিবেশব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা ও অবকাঠামোর ক্ষতি হতে পারে। এতে খাদ্যনিরাপত্তার সংকট ভবিষ্যতে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।

সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে—মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার, মোবাইল ক্লিনিক, ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি—কিন্তু তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত পরিসরে। বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে জলবায়ু অভিযোজন নীতির সঙ্গে প্রজননস্বাস্থ্য সেবাকে সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, স্থানীয় নারী নেত্রী ও বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যুক্ত করে সচেতনতা বাড়ানো গেলে সামাজিক ট্যাবু ভাঙা সম্ভব।

উপকূলের নারীরা কেবল ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী নয়; তারা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে লড়াইয়েরই অগ্রণী সৈনিক। তাদের জীবন-যাপনের অব্যক্ত কথা, তিক্ত অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বকে স্বীকৃতি না দিলে এই সংকটের সমাধান আশা করা কঠিন। এখনই সময়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় ও লবণাক্ত এলাকার নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার।

 

উৎস :

১. গবেষণা: আরেকটি বোঝা বহনের: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ও পরিষেবা লাভের ওপর প্রভাব (ফ্রন্টিয়ার্স ইন ক্লাইমেট)। https://doi.org/10.3389/fclim.2022.875515

২. গবেষণা : বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে প্রজনন আচরণের ওপর আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভাব। digitalcommons.memphis.edu/cgi/viewcontent.cgi?article=4294&context=etd  

৩. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, হুমকিতে উপকূল, দৈনিক প্রথম আলো।

Leave a Reply