আমরা কি জানি না নাকি মানি না? WHO-এর গবেষণায় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমবর্ধমান সংকটগুলো উঠে এসেছে
যারা শিরোনামে প্রশ্নটির অর্থ কী তা ভাবছেন, তাদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)’র একটি সাম্প্রতিক গবেষণার উপর দৃষ্টিপাত করছি। বিশ্বজুড়ে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য উদ্বেগজনক হারে অবনতি হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) এর একটি বিশদ সমীক্ষা অনুসারে, ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৫৬% নারীরা এখন সপ্তাহে একবারের বেশি অনিদ্রা, মাথাব্যথা এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
গত ৭ বছরে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ৪৩ শতাংশ। এই মানসিক সমস্যাগুলির পিছনে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে, যা একইসাথে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার (SRHR) এবং টেকসই উন্নয়নের বৃহত্তর লক্ষ্যগুলির সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।
এই সমীক্ষার প্রধান গবেষক নেদারল্যান্ডসের গোনেকে স্টিভেনস উল্লেখ করেছেন যে, নারীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট তার নিজ দেশেও গুরুতর, যদিও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মতো ভয়ঙ্কর নয়। নেদারল্যান্ডে, ৫০% মেয়ে ২০২২ সালে এই ধরনের অভিযোগের রিপোর্ট করেছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ১৮ শতাংশের কিছু বেশি।
এই সমীক্ষায় স্কুলে পড়াশুনার চাপ এবং কোভিড-১৯ মহামারীর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলো নারীদের উপরে যে বিপুল মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে তা তুলে ধরেছে। বিশেষকরে মহামারী চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় নারীদের উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে, যারা পুরুষদের তুলনায় শারীরিক ও সামাজিক সংযোগের উপর বেশি নির্ভর করে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs), বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা (SDG 3) এবং লিঙ্গ সমতা (SDG 5) এর সাথে সম্পর্কিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কিশোরী মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যাবশ্যক, এবং এই সংযোগগুলিকে উৎসাহিত করে এমন উদ্যোগগুলি তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখতে পারে।
সামাজিক সম্পর্ক তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্টিভেনস পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব এবং সহপাঠীদের সাথে ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বের উপর জোর দেন। সংকট থাকা সত্ত্বেও, ডাচ যুবকরা তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলি গঠন এবং বজায় রাখার ক্ষমতার কারণে তুলনামূলকভাবে ভালভাবে এগিয়ে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষকরে, হারলেম এবং আমস্টারডামের “মিউজিয়াম অফ দ্য মাইন্ড” এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প ও সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলাভাবে সংযুক্ত এবং আলোচনা করার জন্য জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে।
“দ্য মিউজিয়াম অফ দ্য মাইন্ড” মানসিক স্বাস্থ্যকে দৈনন্দিন আলোচনার বিষয় করে তোলার লক্ষ্যে বিশেষায়িত শিল্পকর্মের উপর গুরুত্বারোপ করে। এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জেসিকা বেলেস উল্লেখ করেছেন যে, বিশেষায়িত শিল্পকর্ম, যেমন একটি এক মিটার-উচ্চ ‘গোলাপী হাতির‘ পেইন্টিং, অব্যক্ত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রতীক হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই জাদুঘরটি স্বেচ্ছাসেবী লিয়ার মতো কিশোর-কিশোরীদের জন্য, যিনি এংজাইটি (উদ্বেগ) এবং প্যানিক অ্যাটাক (আকস্মিক আতঙ্ক) এর সাথে দীর্ঘদিন লড়াই করে আসছে, তাদেরকে সমাজে সংযুক্ত হওয়ার জন্য আর্ট ও ফটোগ্রাফির মতো চিত্তাকর্ষক বিষয়গুলো অনুসরণ করার সুযোগ প্রদান করছে।
ডাচ সেন্টার ফর ইয়ুথ হেলথ (এনসিজে)-এর উদ্যোগে “জে ব্রেইন দে বাস?! (আপনার ব্রেন কি আপনার বস?)” এর মত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষামূলক প্রোগ্রামও তৈরি করা হয়েছে, যা প্রায় ৫,০০০ স্কুলে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই প্রোগ্রামগুলো ছাত্রদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের না বলা কথাগুলো বলতে পারে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে।
যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ডাচ কিশোর-কিশোরীরা আন্তর্জাতিকভাবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম স্কোর করে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। নেদারল্যান্ডসে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার পরামর্শ দেয়, যা অন্যান্য দেশের জন্য একটি মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে।
স্টিভেনস ডাচদের দৃঢ় সামাজিক সম্পর্ক এবং বিশ্বাসের বন্ধনের উপরে গুরুত্বারোপ করে ডাচ যুবকদের মানিয়ে চলার ক্ষমতা সম্পর্কে আশাবাদী রয়েছেন। তবুও, তিনি নেদারল্যান্ডস এবং ইউরোপ জুড়ে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করেন।
মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি শুধু একটি জাতীয় সমস্যা নয় বরং একটি বৈশ্বিক বিষয়, যা SRHR এর অগ্রগতি এবং SDG অর্জনের জন্য অতীব জরুরী। তাই ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশকে উৎসাহিত করে এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
এখন যেহেতু আমরা পরিস্থিতির ব্যাপকতা সম্পর্কে জানলাম, তো এখন প্রশ্ন হল – আমরা কি আমাদের মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া শুরু করতে ইচ্ছুক? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় সামাজিক চাপ মোকাবেলা করতে হবে। আর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে – ‘চলছে চলুক-শাপলা শালুক’!
উৎস: NOS – The Nederlandse Omroep Stichting (Dutch Broadcasting Foundation)
ছবি স্বত্ব: Wikimedia Commons