যুদ্ধ-সংঘাতের আড়ালে নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্যের নীরব কান্না!

মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, “বদলা নেওয়ার জন্য চোখ উপড়ে নিলে একসময় পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে।” এই কথা যুদ্ধ এবং সংঘাতের ভয়াবহ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ দিকটিকে তুলে ধরে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যুদ্ধ, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বা মানবিক সংকটের কারণে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া নারী ও কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকারের প্রতি বিশ্ব যেন আরও বেশি উদাসীন!

এই কঠিন পরিস্থিতিগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগগুলোও সীমিত হয়ে যায়। ফলে নারী ও কিশোরীরা যৌন সহিংসতা, পাচার এবং জোরপূর্বক বাল্যবিবাহের মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংগ্রাম, আল-শাবাবের বিভীষিকা, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের দুর্ভোগ, কিংবা ফিলিস্তিনের নারীরা যে কষ্ট বছরের পর বছর ধরে সহ্য করে আসছেন —সব ক্ষেত্রেই যেন একই চিত্র। সংঘাতকবলিত এসব অঞ্চলের নারীরা অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত এবং উচ্চ মাতৃমৃত্যু হারের শিকার হন।

১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্ব স্বীকার করে এসেছে যে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন। তবুও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অনিরাপদ পরিবেশ, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী না থাকা, খরচ বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব এবং সহিংসতার ভয়ের মতো নানা কারণে এটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দিকে তাকালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ মনে হয়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতকের মৃত্যুহারের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ৫৪টি দেশের মধ্যে ৪০% হলো ভঙ্গুর বা সংঘাত-কবলিত অঞ্চল। মাতৃমৃত্যুর পরিস্থিতিও বেশ করুণ। অন্য একটি গবেষণা বলছে, প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যুর আনুমানিক ৬০% ঘটে সংঘাতপূর্ণ এলাকায়। এসব অঞ্চলে মাতৃমৃত্যুর হার শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের তুলনায় দ্বিগুণ হতে পারে।

মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা এবং জরুরি প্রসূতিসেবার অভাব তো আছেই, এর সঙ্গে নারীদের ওপর চেপে বসেছে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের এক পুরনো অভিশাপ—তা হলো লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা। অড্রে হেপবার্নের কথায়, “যুদ্ধক্ষেত্রে নারী ও মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়।” শোষণ ও নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েরা প্রায়শই অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ, যৌনবাহিত সংক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ট্রমার শিকার হন। এমনকি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা কিংবা কন্যাকে সহিংসতা থেকে রক্ষা করার তাড়নায় অনেক অভিভাবক অল্প বয়সে তাদের মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেন। এর ফলস্বরূপ, প্রায়ই কম বয়সে গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও, এমনকি যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো সম্প্রতি স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিনে বোমা হামলা অব্যাহত আছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনে শান্তি আনতে ব্যর্থ। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের মতো ফিলিস্তিনের পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। যেখানে জীবন বাঁচানোই এক কঠিন সংগ্রাম, সেখানে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং যৌন ও প্রজনন অধিকারের অনুপস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে চিন্তিত করে তুলছে না।

সুদান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে সন্তান জন্মদান ও মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মতো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিষয়গুলোও বিপদের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ সেই সময়গুলোতে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, ক্লিনিকগুলো ধ্বংস হয়, চিকিৎসা সরঞ্জাম দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, এবং যোগ্য কর্মীরা পালিয়ে যান। নারীরা বাধ্য হন সহায়তা ছাড়াই সন্তান প্রসব করতে, যা প্রসূতি ফিস্টুলা এবং রক্তক্ষরণের মতো মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকিগুলোকে বাড়িয়ে তোলে। যখন জীবনের উপরই ঝুঁকি বাড়ে, তখন এই স্বাস্থ্যসেবার অভাব মানুষের অধিকারগুলোকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে।

এমন ভয়ানক পরিস্থিতির মাঝেও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জন্য কাজ করেন। তারা শিশুদের জন্মদানে সহায়তা করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। তাদের এই ত্যাগ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে উন্নত করে, যা অন্ধকারের মধ্যেও আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমাদের স্বীকার করতে হবে, প্রজনন স্বাস্থ্য সংঘাত শেষ হওয়ার পরে সমাধানের জন্য কোনো দ্বিতীয় ধাপের উদ্যোগ নয়। এটি হলো মানবাধিকারের এক মৌলিক ভিত্তি, যা সংঘাতের আগে, পরে এবং চলাকালীন সময়েও সমুন্নত রাখতে হবে।

বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে গান্ধীর সেই কথা— “বদলা নেওয়ার জন্য চোখ উপড়ে নিলে একসময় পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে” —বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষের জন্য সত্য না হয়ে ওঠে।

Leave a Reply