দলিত নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা: বঞ্চনার মাঝেও সেবা গ্রহণের নতুন চিত্র!

প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা একটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে দিক থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা  একটি  দেশের উন্নয়নের মাপকাঠিও বটে। কালের পরিক্রমায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি ও পদক্ষেপের কারণে দেশে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার যথেষ্ঠ প্রসার ঘটেছে। তবে দেশের সকল নাগরিক সমানভাবে এ সেবা পাচ্ছেনা। এই ক্ষেত্রে সচেতনতার  কারণেই শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মানুষেরা অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। তবে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায়  শিক্ষা কিংবা সচেতনতা তথা  সামাজিক  অবস্থানের কারণে এখনো উপেক্ষিত রয়ে গেছে দলিত নারীরা।

গণমাধ্যমে “প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা থেকে দলিত নারীরা উপেক্ষিত” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দলিত নারী লক্ষ্মী রানীর বিয়ের দু’বছরের মাথায় প্রথম সন্তান গর্ভে আসে। মা হওয়ার বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস তার মধ্যে ছিল না। তার দৃষ্টিতে ‘সন্তান জন্ম দেয়া’ সংসারের আর পাঁচটা কাজের মতোই! তাই প্রথমবার গর্ভবতী হওয়ার পরও স্বামী কোনোদিন কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে তাঁর চেকআপ করান নি। এমনকি প্রসব ব্যথা উঠলেও লক্ষ্মীকে বাড়ির কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার ‘সাহস’ হয়নি স্বামীর। কারণ, লক্ষ্মীরা অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য। হাসপাতাল তাদের কাছে ‘সংরক্ষিত এলাকা’। তার বদলে বাড়িতে ডেকে আনা হয় পরিচিত দাই (যে নারী সন্তান প্রসবের সময় সাহায্য করেন এবং নবজাতকের যত্ন নেন।) কে। দাইয়ের তিনদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে মৃত সন্তান প্রসব করে লক্ষ্মী।

কিন্তু এখানেই লক্ষী’র কষ্টের শেষ হয়ে যায় নি! বরং কয়েক দিন পর নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় ফিস্টুলা। যার কারণে তার প্রস্রাব, পায়খানার পথ এক হয়ে যায়। এ অবস্থায়ও চিকিৎসকের কাছে নেয়ার ‘ঝামেলায়’ জড়ায়নি তার স্বামী। উল্টো লক্ষ্মীকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ‘ঝামেলামুক্ত’ হয় সে। এটি কোনো অজপাড়া গাঁয়ের ঘটনা নয়, লক্ষ্মীর নিবাস ঢাকা শহরের ওয়ারীতে। যারা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন, তারা জানেন, এ ধরণের ঘটনা দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে। কেবল জীবিত সস্তান প্রসব করাতেই যেন তাদের স্বস্তি। গর্ভবতী মা ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য তাদের কাছে একেবারেই গৌণ বিষয়।

যদিও দেশজুড়ে থাকা কমপক্ষে ১১০ জাতি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন পেশার দলিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। শুধুমাত্র জন্মগত অথবা পেশাগত পরিচয়ের কারণে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার ভোগ অন্যদের তুলনায় কম। আবার দলিত পুরুষদের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দলিত নারীদের অভিগম্যতা আরও কম। এ দু’টি ক্ষেত্রে দলিত নারীরা দু’ভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হন। প্রথমত, দলিত হিসেবে বৃহৎ সমাজে এবং দ্বিতীয়ত, নিজ সমাজে নারী হিসেবে। নারী স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যে বাল্য বিয়ে, দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে তার হার সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী দলিত নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে “Maternal Health-Seeking Process of Dalit Women in Dhaka” শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণগত গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত, দলিত জনগোষ্ঠী সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক ও বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কেমন, তা জানতেই এই গবেষণাটি করা হয়েছে।

দলিত নারীদের মধ্যে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে, তা বিশ্লেষণ করাই ছিল গবেষণাটির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ কোয়ার্টারে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এখানকার দলিত পরিবারগুলো বংশানুক্রমিক কাজের কারণে এই ‘মহল্লা’ নামের সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে বসবাস করেন। গবেষক নিবিড়ভাবে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই গবেষণাটিতে মোট ত্রিশ জন বিবাহিত নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন।

গবেষণাটির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী দলিত নারীদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো: এই নারীরা তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালের প্রতি নির্ভরতা দেখান; বসবাসের স্থানের খুব কাছাকাছি হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং হেঁটেও সেখানে যেতে পারেন ।

অর্থনৈতিক কারণেও তাদের এই পছন্দ, তারা মনে করেন অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করা কঠিন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় তারা এটিকেই বেশি প্রাধান্য দেন। স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তারা সচেতন; এক নারী জানান যে আজিমপুর মাতৃসদনে সবাই নারী কর্মী হওয়ায় তিনি সেখানে বেশি আরামদায়ক বোধ করেন, যেখানে ঢাকা মেডিকেলে পুরুষদের উপস্থিতি থাকে।

প্রসবের ক্ষেত্রে, হাসপাতালে প্রসবের প্রবণতা সুস্পষ্ট, এই এলাকার দলিত নারীরা হাসপাতালকেই কেন্দ্রীয় স্থান হিসেবে বেছে নেন এবং তাদের পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও হাসপাতাল প্রসবকেই নিরাপদ ও উত্তম বলে মনে করেন। এমনকি তাদের নাতি-নাতনিদেরও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই জন্ম হয়েছে বলে জানা যায়। প্রসূতি মায়ের চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও যত্নে পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; স্বামী, মা, শাশুড়ি ও বড় বোনসহ নিকটাত্মীয়দের একটি বড় প্রভাব দেখা যায় এবং এই আত্মীয়স্বজনদের পরামর্শ ও নির্দেশনাকে তারা কর্তৃত্বপূর্ণ জ্ঞান হিসেবে মেনে চলেন ।

সবথেকে ইতিবাচক দিক হলো, ঢাকা শহরের এই সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করার কারণে দলিত নারীরা স্থানীয় ডিসপেনসারি বা কাছাকাছি হাসপাতালগুলোতে দলিত হিসেবে কোনো বৈষম্যের শিকার হন না। গবেষণাটি দেখা যায় যে, স্থান এবং আর্থিক অবস্থার কারণে এই নির্দিষ্ট এলাকার দলিত নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার ধরনটি প্রধানত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। হাসপাতাল এখানে প্রসবের জন্য প্রধান কেন্দ্র। যদিও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে এখনও অনেক বঞ্চনা রয়েছে, কিন্তু এই গবেষণাটি প্রমাণ করে যে, ভৌগোলিক নৈকট্য ও আর্থিক সহজলভ্যতা পেলে দলিত নারীরাও প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্নে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই বেছে নেন ।

এই ধরনের গবেষণা নীতিনির্ধারক ও উন্নয়ন গবেষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গ্রামীণ দলিত নারীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রক্রিয়া কেমন, তা নিয়ে আরও বিস্তৃত আকারে গবেষণা করা প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকদের উচিত, এই মডেলকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রামীণ ও অন্যান্য বস্তি এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, যাতে সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।

উৎস : বাসস ও গবেষণা প্রতিবেদন । 

Leave a Reply