আর নয় অবৈজ্ঞানিক অপবাদ: বাংলাদেশের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ বিষয়ে প্রথা ভাঙ্গার সময় এখনই
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এখনও কন্যাসন্তান জন্মানোকে অনেক সময় ভালোভাবে মেনে নেওয়া হয় না, অনেকে আবার এটাকে দুর্ভাগ্য ভাবেন। কন্যাসন্তানের জন্ম অনেক সময় নীরবতা, হতাশা বা দোষারোপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এর দোষ গিয়ে পড়ে মায়ের ঘাড়েই—যেন মেয়ে সন্তান হওয়াটা শুধুই তাঁর দায়! কিন্তু এই বিশ্বাস একেবারেই বৈজ্ঞানিক নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমাজে এমন ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে — যার মধ্যে অন্যতম হলো, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে মা। বরং এই ভুল ধারনাগুলো নারীদের প্রতি অবিচার, এমনকি নির্যাতনের পথ তৈরি করে দেয়।
এই অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস শুধুমাত্র ভুল তথ্যই নয়, এটি নারীর প্রতি বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞান একেবারে ভিন্ন এবং ক্ষমতায়নমূলক সত্য তুলে ধরে—যেটি ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের সচেতনতা ও লিঙ্গ সমতা গড়ে তুলতে হবে। অথচ বিজ্ঞান একেবারে স্পষ্ট করে প্রমাণ করে দিয়েছে—সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে, সেটি নির্ভর করে বাবার শরীর থেকে আসা জিনের ওপর। এখন সময় এসেছে এই সত্যটা জানার, আর সমাজ থেকে এই দোষারোপের সংস্কৃতি ভাঙার।
শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের জেনেটিক সত্য
সন্তানের লিঙ্গ নির্ভর করে বাবা-মায়ের শরীর থেকে আসা একজোড়া বিশেষ জিন বা ক্রোমোজোমের ওপর। মায়ের ডিম্বাণু সব সময়ই X ক্রোমোজোম বহন করে। কিন্তু বাবার শুক্রাণু হয় X নয়তো Y ক্রোমোজোম বহন করে। যদি ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার সময় দুইটি X ক্রোমোজোম থাকে, তাহলে সন্তান মেয়ে (XX), আর যদি একটি X আর অপরটি Y থাকে, তাহলে ছেলে (XY)। অর্থাৎ, সন্তানের ছেলে না মেয়ে হবে, সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে বাবার শুক্রাণুর ওপর। মায়ের কোনো হাত নেই এখানে।
এই বৈজ্ঞানিক সত্যটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেক মানুষ এই সহজ তথ্যটা জানেন না বা বিশ্বাস করেন না।
লিঙ্গ নির্ধারণের জেনেটিক সত্য
লিঙ্গ নির্ধারণের মূল বিষয়টি একেবারেই সহজ ও বৈজ্ঞানিক — শিশুর ছেলে না মেয়ে হবে, তা নির্ভর করে বাবার ক্রোমোজোমের উপর।
জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, প্রতিটি মানুষের শরীরে লিঙ্গ নির্ধারণকারী এক জোড়া যৌন ক্রোমোজোম থাকে। মায়ের ডিম্বাণু সর্বদা একটি X ক্রোমোজোম প্রদান করে। কিন্তু বাবার শুক্রাণু হয় X ক্রোমোজোম, বা Y ক্রোমোজোম বহন করতে পারে। যখন X ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণু মায়ের X ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, তখন ফলাফল হয় XX — অর্থাৎ মেয়ে। আর যখন Y ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণু মায়ের X ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, তখন ফলাফল হয় XY — অর্থাৎ ছেলে।
অর্থাৎ, শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে বাবার শুক্রাণু — মায়ের নয়। যুক্তরাষ্ট্রের National Human Genome Research Institute সহ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এটি স্বীকৃত করেছে। তবুও, বাংলাদেশে এই সহজ বৈজ্ঞানিক সত্যকে ছাপিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার ও মিথ চালু রয়েছে।
ভুল ধারণার ভয়াবহ ফল
২০১৯ সালে UNFPA বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে পরিবারের কাছ থেকে সমালোচনা বা দোষারোপের শিকার হন। এই দোষারোপ থেকে অনেক সময় মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত গড়ায়। এতে করে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়ে।
শহর হোক বা গ্রাম—অনেক নারী আজও শুধু মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কটাক্ষ, অবহেলা বা অপমানের মুখোমুখি হন। এই ধরণের মানসিকতা আবার কিছু ক্ষেত্রে ভয়ংকর রূপ নেয়—যেমন গর্ভে সন্তানের লিঙ্গ জেনে গর্ভপাত ঘটানো, যা বেআইনি তো বটেই, মানবিকভাবেও অন্যায়।
জ্ঞান দিয়েই সমতা গড়া সম্ভব
এই ভুল ধারণাগুলো দূর করতে হলে দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা। Share-Net Bangladesh-এর #Chromosome_Talk ক্যাম্পেইনের মতো উদ্যোগগুলো দেখিয়েছে—যত বেশি মানুষ জানবে, তত কমবে অজ্ঞতা। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করতে হবে—স্কুলে, পরিবারে, সমাজে।
সঠিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা থাকা দরকার, যাতে ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই সত্যিকারের তথ্য জানতে পারে। বাবা-মা, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, স্বাস্থ্যকর্মী—সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই বিষয়টা শুধু মেয়েদের নয়, পুরো সমাজের ব্যাপার।
নতুন করে ভাবার সময় এসেছে
এখন সময় এসেছে দোষারোপ না করে ভালোবাসার জায়গা থেকে ভাবার। মেয়ে বা ছেলে—সন্তান মানেই আশীর্বাদ। তাদের মর্যাদা, অধিকার, যত্নে কোনো ফারাক থাকা উচিত না। একজন মানুষের গুণ, ব্যবহার, সম্মানই তার আসল পরিচয়— তা সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক।
তাই কন্যাসন্তান জন্মে কেউ যেন আর দুঃখ না করি। আর কোন মায়ের গায়ে “ছেলে দিতে পারোনি” এই ধরনের কুৎসিত কথা যেন আর না আসে। কারণ, বিজ্ঞান পরিষ্কার বলছে—সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ বাবার থেকেই হয়। কন্যাসন্তান জন্মানোয় কোনো দোষ নেই—বরং দোষ আছে তাদের যারা দোষারোপ করে।
সত্য জানিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই সমাধান
একটা ন্যায্য ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের এই সত্যগুলো জানতে হবে, মানতে হবে, সঠিক জ্ঞানের প্রচার করতে হবে। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করতে হলে আমাদের জানাতে হবে—সমতার শুরু হওয়া উচিত গর্ভ থেকেই। আর প্রতিটি সন্তানের প্রতি মায়া, ভালোবাসা, ও যত্নের মধ্য দিয়েই এই যাত্রা শুরু করা সম্ভব। চলুন, এই মিথ ভাঙি। দোষারোপ থামাই। আর এমন একটা বাংলাদেশ গড়ি, যেখানে প্রতিটি সন্তান হবে গর্বের, আবেগের, ভালোবাসার প্রতীক—লজ্জার নয়।
সূত্রঃ
- UNFPA Bangladesh (2019)
- National Human Genome Research Institute (genome.gov)