ভিড়, ভয় ও সামাজিক চাপ: রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীদের প্রজননস্বাস্থ্য সেবার মূল বাধা!

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলি মূলত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিস্তৃত এক বিশাল মানবিক সংকটময় পরিস্থিতির কেন্দ্র, যেখানে মিয়ানমার থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেকটি শরণার্থী শিবিরই অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও জনবহুল শরণার্থী স্থাপনাগুলির মধ্যে এগুলো অন্যতম। এখানে হাজার হাজার তাঁবু, বাঁশ–তাঁবুর ঘর, কমিউনিটি সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র এবং নিরাপত্তা পোস্ট মিলিয়ে একটি চ্যালেঞ্জপূর্ণ মানবিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ব্যবহার বিভিন্ন ধরণের বাধার মুখে রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ট্যাবু, লজ্জাবোধ এবং কমিউনিটির নজরদারির কারণে তারা প্রয়োজনীয় সেবা নিতে দ্বিধায় ভোগে। বিশেষ করে তরুণীদের চলাচলে সীমাবদ্ধতা, পুরুষ সেবা-প্রদানকারীর কাছে যাওয়ার অস্বস্তি এবং নিরাপত্তাহীনতা সেবা গ্রহণকে আরও কঠিন করে তোলে। গোপনীয়তার অভাব, ভুল ধারণা ও সচেতনতার ঘাটতি তরুণদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য (SRH) তথ্য জানার চর্চাকে সীমিত করে রাখে, ফলে সেক্সুয়াল ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন (STI) পরীক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা বা জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা (GBV) সম্পর্কিত সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। 

পাশাপাশি শিবিরভিত্তিক কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ যেমন, সেন্টারের দূরত্ব, ভিড়, পরিবার পরিকল্পনা উপকরণের স্বল্পতা, এবং মানসম্মত কাউন্সেলিংয়ের অভাব, সেবা গ্রহণের প্রবেশাধিকার আরও সংকুচিত করে ফেলে। জরুরি রেফারাল বা উন্নত চিকিৎসার ক্ষেত্রেও যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক বিধিনিষেধ উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করে। সামগ্রিকভাবে, তরুণ রোহিঙ্গাদের SRH সেবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সামাজিক ট্যাবু, নিরাপত্তা, তথ্যের অভাব ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার সমন্বয় একটি জটিল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে বসবাসকারী তরুণ-তরুণীদের প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি বিষয়ে ‘Barriers to access and utilization of sexual and reproductive health services among young Rohingya refugees in Bangladesh’ শীর্ষক প্রকাশিত একটি গুণগত গবেষণায় এই বাধাগুলির জটিল প্রকৃতি উঠে এসেছে। গবেষণাটির মূল অনুসন্ধান হলো, সেবাগুলির ‘উপস্থিতি’থাকা সত্ত্বেও সামাজিক নিয়ম, লিঙ্গভিত্তিক প্রথা এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের (বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা) জটিলতা কীভাবে সেবা গ্রহণ করাকে কঠিন করে তুলছে, সেটি দেখা।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় মূলত শরণার্থী-ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮–২৪ বছর বয়সের যুব ও যুবতীরা SRH সেবা গ্রহণে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। গবেষণায় মোট ১২ জন তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থী৭ জন সেবা প্রদানকারীর in-depth interviews-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে প্রথমত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাব যেমন অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের জন্য যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য সেবা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে সামাজিক রীতি-নীতি, লজ্জা ও ‘উচিত নয়’ এমন ধারণা তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোয় সীমাবদ্ধতা রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, অত্যাধিক ভিড়, পরিষেবার সময়ের অপ্রতুলতা, গোপনীয়তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থার অভাব, ও বিশেষত যুববান্ধব সেবার ঘাটতি। 

সবমিলিয়ে, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে মানেই এই নয় যে তরুণ-তরুণীরা তা গ্রহণ করতে পারবে, কারণ নেতিবাচক সামাজিক রীতিনীতি, মানুষের মনে থাকা সংকোচ এবং সেবার মানের দুর্বলতা, এসব বিষয় একত্রিত হয়ে স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। বিদ্যমান এই সকল কারণে তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ ও সেবার গুণগত দিক উভয় ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। 

এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো ‘বহুবিধ পরিচয়ের প্রভাব বিশ্লেষণ পদ্ধতি’ (Intersectionality Framework)  ব্যবহার করা। এই পদ্ধতি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, বর্তমানে চালু থাকা সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিগুলো মানুষের বিভিন্ন ধরনের পরিচয়, যেমন কেউ অবিবাহিত তরুণী বা বিবাহিত পুরুষ, এগুলো কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতাকে পাল্টে দেয়, কিন্তু সেদিকে কারো কোনো গুরুত্ব থাকে না। বিশ্বজুড়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) এবং মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই ফলাফলগুলো খুবই জরুরি ও প্রয়োজনীয়। এই ফলাফল থেকে বোঝা যায়, শুধু ক্লিনিকের সংখ্যা বা সেবার যোগান বাড়ালেই হবে না, বরং, সেবার প্রক্রিয়াটিকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে সেটি প্রতিটি মানুষের বৈবাহিক অবস্থা, লিঙ্গ, বয়স ও সামাজিক রীতিনীতি-এর মতো বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল হয়। 

একই সাথে, অবিবাহিত তরুণ-তরুণীরা যেন সামাজিক ‘কলঙ্কের’ ভয় এড়িয়ে নির্দ্বিধায় সেবা নিতে পারে, সেজন্য তাদের জন্য সম্পূর্ণ গোপনীয়তা ও বিশেষ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি, SRH কর্মসূচির মূল কাজ শুধু ক্লিনিকাল সেবাতেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয় বরং, সমাজের ক্ষতিকর সামাজিক ও জেন্ডারভিত্তিক প্রথাগুলো দূর করার দিকেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। সবমিলিয়ে, এই গবেষণা এটাই প্রমাণ করে যে, শরণার্থী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সময় কেবল বয়সের ভিত্তিতে নয়, বরং মানুষের বিভিন্ন পরিচয়ের জটিলতা বুঝে বিশেষায়িত ও উপযুক্ত উদ্যোগ নেওয়ার বিকল্প নেই।

 উৎস : বায়োমেড সেন্ট্রাল লিঃ।

Leave a Reply