জীববিজ্ঞান নয়, জীবনবোধ: ‘শাহানা’ কার্টুন সিরিজ কেন আজ বাংলাদেশের পাঠ্যসূচির অংশ

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ‘শাহানা’ শুধু একটি কার্টুন নয়, এটি যেন এক নতুন জীবনমুখী পাঠশালা। যেসব সংবেদনশীল বিষয় আজও সমাজের কোণে ফিসফিস করে বলা হয়, শাহানা সেই নীরবতার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর-এর নেতৃত্বে এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সহযোগিতায় জন্ম নেওয়া এই সিরিজটির একটি সরল অথচ সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল দেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর ও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সঠিক তথ্য ও ব্যবহারিক জীবনদক্ষতা দিয়ে প্রস্তুত করা, যা সাহানা কার্টুন এর সারা দেশের যাত্রায় ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌন শিক্ষাকে শুধুমাত্র কয়েকটি জৈবিক প্রক্রিয়ার বিবরণে সীমাবদ্ধ রাখলে তার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এর পরিধি অনেক বিস্তৃত। শরীরবিদ্যা, প্রজনন স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা, সম্মতি, লিঙ্গসাম্য এবং সুস্থ সম্পর্ক স্থাপন- এই সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। শাহানা কার্টুন এর সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যাপার হচ্ছে বয়সোপযোগী চরিত্র ও বাস্তবসম্মত গল্পের মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, সম্মতি (Consent), বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, সাইবার নিরাপত্তা, মানসিক সুস্থতা এবং দ্বন্দ্ব নিরসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে খুব সহজ করে তুলে ধরে।  এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কার্টুনটির প্রচেষ্টা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের National Adolescent Strategy’-কে সমর্থন করে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য।

সিরিজটির পথচলা তিনটি ধাপে এগিয়েছে। সিরিজ ১ (২০১৫) বয়ঃসন্ধি, লিঙ্গবৈষম্য ও হয়রানির মতো ভিত্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সিরিজ ২ (২০১৮) ‘ট্রুথ অর ডেয়ার’ বা ‘দ্য বিউটি অফ ডাইভারসিটি’-এর মতো পর্বের মাধ্যমে শিক্ষাকে আরও গভীর করে। এরপর সিরিজ ৩ আসে দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনা এবং সাইবার সুরক্ষার মতো সময়োপযোগী চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটিকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণ সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে, সিরিজটি দেশের ৩৩,০০০ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় প্রদর্শিত হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে আজও ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ-এর ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। এই ব্যাপক পরিসরে শাহানার প্রচার বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় এক বিশাল নীতিগত পদক্ষেপ।

শাহানা কার্টুন মাঠপর্যায়ে যে প্রভাব ফেলেছে, তা যেন আবারও মনে করিয়ে দেয় সেই প্রাচীন প্রবাদ—“প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা।” দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) বিষয়ে যে সামাজিক লজ্জা আর সংস্কৃতিগত বাধা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে, শাহানা সেখানে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই বাধাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার। শিক্ষার্থীরা বলছে, ঋতুস্রাব ও বাল্যবিবাহের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে কার্টুনে যেভাবে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা শুধু কৈশোরকে “স্বাভাবিক” করে তুলেনি, বরং এসব বিষয় নিয়ে লজ্জা-আড়ষ্টতার গ্লানি অনেকটা দূর করে দিয়েছে। এর প্রভাব শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশেও স্পষ্ট। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, আগে যে বিষয়গুলো নিয়ে মুখ খুলতে শিক্ষার্থীরা সংকোচ বোধ করত, এখন সেগুলো নিয়েই খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে, হাসি-ঠাট্টার বদলে আসছে কৌতূহল আর বোঝাপড়ার মনোভাব।

শাহানা সত্যিই প্রমাণ করেছে, ব্যাপক যৌনতা শিক্ষা কেবল ‘জীববিজ্ঞান’ নয়, বরং জীবন দক্ষতা, নিরাপত্তা ও সম্মানের পাঠ।

 

 

Sources:

Shahana: An Edutainment Cartoon Promoting Life Skills for Bangladesh’s Adolescents
Feature video on Shahana
Sahana Cartoon series
Bangladesh National Adolescence Health Strategy

Leave a Reply