বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস ২০২৫: পরিকল্পিত সিদ্ধান্তেই সম্ভব সুরক্ষিত জীবন
প্রতি বছর ২৬শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস পালন করা হয়, যার উদ্দেশ্য হলো প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও পছন্দের গুরুত্ব তুলে ধরা। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় “সবার জন্য পছন্দ – সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, সুযোগ”। এই প্রতিপাদ্যটি একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে: সেটি হলো- কোনো বাধা, কুসংস্কার বা বৈষম্য ছাড়াই প্রতিটি নারীই সন্তান ধারণ করবে কিনা, করলে কখন করবে এবং কিভাবে করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
গর্ভনিরোধ শুধুমাত্র গর্ভধারণ রোধ করা নয়; এটি বিশেষ করে নারী ও তরুণ-তরুণীদের জন্য মর্যাদা, প্রজনন স্বায়ত্তশাসন এবং সঠিক তথ্য এবং উপযুক্ত পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করার একটি মাধ্যম। বাংলাদেশে, যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা এখনও সীমিত, সেখানে অনেক নারী ও মেয়ে সঠিক তথ্য, সাশ্রয়ী গর্ভনিরোধক উপকরণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন। এর ফলে প্রায়শই অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি চক্র তৈরি হয়, যা সঠিক সহায়তার মাধ্যমে সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এই প্রতিপাদ্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরেছে। প্রথমত, সিদ্ধান্ত – অর্থাৎ ব্যক্তি, বিশেষ করে নারীদের, তাদের শরীর ও জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা – সমাজ, পরিবার বা ক্ষতিকর প্রথা থেকে কোনো চাপ ছাড়াই নিজের ইচ্ছায় মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের পরিকল্পনা করার সক্ষমতা। তৃতীয়ত, সুযোগ – অর্থাৎ গর্ভনিরোধক পদ্ধতি, শিক্ষা এবং পরামর্শ সবার জন্য সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া, বিশেষ করে গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মানুষের জন্য।
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যে অগ্রগতি হলেও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। কিশোরী মেয়েরা প্রায়শই ব্যাপক যৌন শিক্ষা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়, এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের বিবাহিত নারীরা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির চাপ অনুভব করেন, যা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করে। অনেকের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া অস্বস্তিকর বা অনিরাপদ মনে হয়ে থাকে, ফলে গর্ভনিরোধ সম্পর্কিত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো এখনও মনে ভয় তৈরি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলো শক্তিশালী নীতি, কমিউনিটি সচেতনতা কর্মসূচি এবং যুব-বান্ধব পরিষেবার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।
বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারদের এই বাধাগুলো দূর করতে একসাথে কাজ করার জন্য একাত্মতা প্রয়োজন। স্কুল, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা সঠিক তথ্য প্রচারে এবং খোলামেলা, কুসংস্কারমুক্ত আলোচনাকে উৎসাহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। ফার্মেসি, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্য বিষয়ক নলেজ প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে গর্ভনিরোধক বিষয়টি সহজলভ্য করার মধ্য দিয়ে একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
এই দিবসের মূল বার্তা হলো এমন একটি সমাজ তৈরি করা, যেখানে গর্ভনিরোধক পদ্ধতি সবার জন্য সহজলভ্য এবং সবার প্রজনন অধিকারকে সুরক্ষিত করবে। এটি কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা স্বাস্থ্যবিষয়ক বিষয় নয়, বরং একটি মানবিক অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়। যখন নারী ও পুরুষ নিজেদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তখন তারা সুস্থ থাকেন, পরিবার আরও শক্তিশালী হয়। নারী ও পুরুষের মধ্যে, এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে থাকা বৈষম্য অনেকাংশে কমে যায়। সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা এবং সুযোগ। যখন এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা হবে, তখন সমাজের প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, নিজেদের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ পাবেন। এটি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়াবে। এর ফলে তারা শুধু নিজেদের জীবনই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
উৎস: বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস, ইউএনএফপিএ।