সাময়িক সুবিধার অযাচিত মূল্যঃ বাংলাদেশে সি-সেকশন হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির উপরে গভীর দৃষ্টিপাত
দেশে সন্তান জন্মদানের চিত্র বদলে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে সন্তানের স্বাভাবিক জন্মদান প্রক্রিয়া। প্রতি দুজনের মধ্যে একজন সন্তানের জন্ম হচ্ছে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশন) মাধ্যমে। বিপুল নারীর সিজারিয়ানের ফলে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা জটিলতা। মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। প্রভাব পড়ছে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার ওপর। পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, দুই দশক আগেও প্রসূতিরা সিজারিয়ানে অনাগ্রহী ছিলেন। দিন যত যাচ্ছে, সি-সেকশনের প্রবণতা ততই বাড়ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জরিপের তথ্যমতে, ২০০৪ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ সন্তানের জন্মদান হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। গত এক বছরের ব্যবধানে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান উদ্বেগজনক বাড়লেও বন্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
বিবিএস থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে দেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে এ হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে দেশে স্বাভাবিক প্রসবের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এক বছর আগে যা ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছর শহরে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে। এর আগের বছর যা ছিল ৫৩ শতাংশ।
এ ছাড়া হাসপাতালে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ সন্তান জন্ম হয়েছে বাড়িতে। ২০২২ সালে যা ছিল ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। সরকারি হাসপাতালে সন্তানের জন্ম হয়েছে ২৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০২২ সালে ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে সন্তান জন্ম হয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২২ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সি-সেকশনের ক্রমাগত বৃদ্ধির এই হারকে উদ্বেগজনক ও ভয়ংকর বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সাধারণ নিয়ম হলো, প্রসূতির শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে মা ও সন্তানের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেবেন চিকিৎসকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সন্তানের জন্ম সি-সেকশনের মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের ‘অতিরিক্ত ব্যবসা করার মানসিকতার’ কারণে বিনা প্রয়োজনে সি-সেকশনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফলে অনেক বেশি পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাবে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অন্তত ৮ লাখ ৬০ হাজার সি-সেকশন হয়েছিল। এর ৭৭ দশমিক ১ শতাংশই ছিল ‘অপ্রয়োজনীয়’। আর ওইসব অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের পেছনে পরিবারগুলোর খরচ হয়েছে মোট ৩ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে রয়েছে নানা রকম ঝুঁকি।
অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে সংক্রমণ ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি, জমাট রক্ত ইত্যাদির কারণে মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অনেক দীর্ঘ সময় লাগে। আবার সি-সেকশনের কারণে গর্ভাশয়ের ক্ষতি, অস্বাভাবিক প্ল্যাসেন্টেশন, এক্টোপিক গর্ভাবস্থা, ভ্রূণের মৃত্যু, সময়ের আগে শিশুর জন্মের মতো ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি শিশুর হরমোন, শারীরিক ও অন্যান্য বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বেরসকারি হাসপাতালে সি-সেকশনের হার সবচেয়ে বেশি। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রসূতিদের সি-সেকশন করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারি নজরদারি নেই বললেই চলে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। ফলে বছর বছর সি-সেকশন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সি-সেকশন বৃদ্ধির হার ভয়ংকর ও উদ্বেগজনক।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলিজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা কালবেলাকে বলেন, সন্তান জন্মদান একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সিজারিয়ান সেকশন প্রয়োজনীয় অপারেশন। যার মাধ্যমে মা ও শিশুর জীবন রক্ষা করা হয়। এটি কোনো নরমাল প্রক্রিয়া নয়। একটি মেজর অপারেশন। নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে রোগীদের কাউন্সিলিংয়ের অভাবে রয়েছে। প্রসূতি ও তার পরিবার স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তারা সি-সেকশনকে নিরাপদ মনে করে।
এদিকে ২০১৯ সালে প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সরকারি ও বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও চিকিৎসক কর্তৃক অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন আদালত। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি নীতিমালা তৈরি করে হাইকোর্টে দাখিল করা হয়।
ওই নীতিমালায় বলা হয়,
১. অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি—এ তিনটি মেয়াদে বিভক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমে বিদ্যমান যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তা পর্যালোচনা করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা।
২. জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
৩. স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা।
৪. চিকিৎসকদের নৈতিক মানদণ্ড সমুন্নতকরণ বা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত কাউন্সিলিং করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৫. মেডিকেল ডিফেন্স ইউনিট গঠনের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
৬. তথ্য সংরক্ষণ ও রেকর্ডিংয়ের দায়বদ্ধতা ও তদারকীকরণ।
৭. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সূচক—ঠিক কোন কোন শারীরিক পরিস্থিতিতে সিজারিয়ান করা যাবে, তার উল্লেখ রয়েছে।
৮. ইলেকটিভ সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে রোগীকে সম্পূর্ণ তথ্য প্রদান করে তার সম্মতি নিতে হবে; অন্যথায় অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আদায়কৃত সম্মতি আইনের দৃষ্টিতে কোনোরূপ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।
এই রিট পরিচালনাকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ও জবাবদিহি নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমরা সবসময় অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন বা সি-সেকশনের বিপক্ষে। তবুও নানা কারণে সি-সেকশন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যৌক্তিক পর্যায়ে সি-সেকশন কমিয়ে আনতে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।