সাইডলাইন থেকে স্পটলাইটে: বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়দের লড়াই

মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পার্কিং লটের দৃশ্য চোখে পড়লেই এক বিরূপ বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। চকচকে গাড়ি সারি সারি। এগুলো যেন ছন্দস্বরূপ বলছে পুরুষ ক্রিকেটারদের সাফল্য ও পুরস্কারের গল্প। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই গাড়িগুলোর মধ্যে কতটি নারী ক্রিকেটারের?  যেসব নারী একই জার্সি পড়েও  কেন এখনো আর্থিকভাবে বাদ পড়েছেন?

বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়রা মাঠের বাইরে অনেক বড় যুদ্ধ লড়েছেন। কন্ট্র্যাক্ট, স্বীকৃতি এবং মর্যাদা পাওয়ার জন্য তাদের সংগ্রাম অব্যাহত। স্পোর্টসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ফারাক স্পষ্ট, যদিও কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।

নারীদের ফুটবলের কথা যদি আসে, আগস্ট ২০২৩-এ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দেশের নারী ফুটবল দলকে পাঁচগুণ বেতন বৃদ্ধি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শিরোনাম হয়। এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশি নারী ফুটবলারদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো। সাবিনা খাতুন ও রুপনা চাকমার মতো খেলোয়াড়রা এখন মাসিক ১৫,০০০ টাকা থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন। অনলাইন কমেন্ট সেকশনে নারীবিদ্বেষী কমেন্টগুলোতে  কেউ কেউ এটিকে দান হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

এটা কোনো দান নয়এটি স্বীকৃতি, কঠোর পরিশ্রমের ফল, বিশেষ করে ২০২২ সালের  ঐতিহাসিক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর। তবে উদযাপনটি তাৎক্ষনিক বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায়। ২০২৪-এর প্রথম দিকে বোঝা যায়, স্পন্সর তহবিল থেকে এই বেতন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অবশেষে এপ্রিল ২০২৪ থেকে ফিফার বার্ষিক তহবিল ব্যবহার করে বেতন দেওয়ার অনুমতি মেলে। অর্থাৎ, নারী ফুটবল এখন আর্থিকভাবে ফিফার সাহায্যে টিকে আছে।

ক্রিকেটের দিকে তাকাই। ফুটবলের অগ্রগতি থাকলেও ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এখনও দুঃখজনক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সম্প্রতি নারী দলের জন্য ৩৫% বেতন বৃদ্ধি ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক অ্যাসাইনমেন্টে ম্যাচ ফি ও ডে এলাউন্স পুরুষদের সমান করা হয়েছে। কিন্তু মূল বেতন অনেক আলাদা। পুরুষ ক্রিকেটাররা কেন্দ্রীয় চুক্তিতে  ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পান। নারীরা? একক ৩০,০০০ টাকা। অনেকের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বেঁচে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ।

ক্রিকেট ও ফুটবল ছাড়াও অ্যাথলেটিকস, আর্চারি, কাবাডিসহ অনেক খেলায় নারীদের পে-স্কেল আশাব্যাঞ্জক নয়। অ্যাথলেটিকসে নারীরা এখনও এমন সুবিধা পায় না যা প্রয়োজন। কাবাডিতে ম্যাচ প্রায় সম্প্রচার হয় না। অধিকাংশ নারী খেলোয়াড়ের জীবিকা বহন করতে হয় একাধিক কাজ করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী খেলোয়াড়রা অসাধারণ। ওয়েইট লিফটিং-এ মাবিয়া আখতার শিমান্তো বা দৌড়ে শিরিন আখতার। তবে তাদের জয় দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নিরাপত্তা বা প্রতিষ্ঠানিক সমর্থনে রূপ নেয় না। দেশের স্পোর্টস ব্যবস্থা কেবল প্রশংসা দেয়, কিন্তু দায়িত্ব বা স্বীকৃতি  নেয়ার পালায়  অনুপস্থিত।

ক্রীড়া সংস্থাগুলো প্রায়ই ঘোষণা করে যে তারা “প্রতিভা লালন” করতে চায়। তবে যখন একজন নারী ক্রিকেটার উল্লেখ করেন যে তিনি প্রায়ই বেঁচে থাকার কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং ক্রীড়া জীবন স্থগিত করার কথা ভাবছেন, তখন এই লালনের অঙ্গীকার শূন্যপ্রায় মনে হয়।” সমতা কেবল পুরস্কার বা ভাতার বিষয় নয়; এটি মানে খেলোয়াড়দের পেশাদার হিসেবে সম্মান ও মূল্যায়ন করা, লিঙ্গ নির্বিশেষে।

প্রশংসা ও শিরোনাম বিদ্যমান। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত বেতন তাদের নিষ্ঠা ও উদ্যমের সঙ্গে সমতুল্য হবে না, বাংলাদেশি নারী খেলোয়াড়রা অসমতার পরিবেশ থেকে বের হয়ে দৌড়াতে, কিক করতে এবং স্ট্রাইক দিতে অব্যাহত রাখবেন।

সূত্র:

-ঢাকা ট্রিবিউন, ১৭ আগস্ট ২০২৩

-নিউ এজ, ০৭ এপ্রিল ২০২৪

-দ্য ডেইলি স্টার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

Leave a Reply