মানবপাচার রোধে বাংলাদেশের লড়াই: সমস্যা, সমাধান ও করণীয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবপাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সমস্যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এদেশের নারী ও শিশুরা। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সহিংসতা, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য এই দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত “স্টপিং দ্য ট্রাফিক” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এটিকে আধুনিক দাসত্ব ও শিশু অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিষয়ে বর্তমানে অনেক চলমান রয়েছে, এমনকি বেশ কিছু আইনি সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতিও হয়েছে, তারপরও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৯ সালে পালেরমো প্রোটোকল-এ অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মানব পাচার প্রতিরোধ, সুরক্ষা এবং বিচার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।

বাংলাদেশ সার্ক কনভেনশন ও বাংলাদেশ-ভারত আরআরআরআই সমঝোতা স্মারক বিষযে আঞ্চলিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। জোরপূর্বক ও শিশুশ্রম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশনগুলোতেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন (২০১২), এর বিধিমালা (২০১৮), জাতীয় রেফারেল মেকানিজম (২০২৪) এই বিষয়টা মোকাবেলা করার জন্য একটা শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি করেছে।

তবে এদেশের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে কার্যকর ফলাফল আশা করা সম্ভব না। পাশাপাশি বিশেষায়িত মানবপাচার দমন বিচার ট্রাইবুনালগুলোতেও মামলার বিশাল জট রয়েছে। ২০২৪ সালে ৪ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন ছিল। যার মধ্যে মাত্র ৮৮টিতে সাজা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং ইন পারসনস শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের টিয়ার অবস্থান ২ এবং এর মধ্য দিয়ে বুঝা যায় বাংলাদেশ আংশিকভাবে এই সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদন্ড পূরণ করেছে। বাস্তবে বাংলাদেশ মানব পাচারের জন্য পরিচিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, এবং এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত হওয়ার জন্য সকল ধরণের সহায়ক উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যাদের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ কোন রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।

কক্সবাজারে ২০২৪ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে ৩১৬ জন ভুক্তভোগীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। যার অধিকাংশই পুরুষ ও ছেলে। আর যেসকল নারী কর্মীদেরকে পাচার করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশকেই বাসায় বা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জগুলো কিশোরী এবং নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবেদনের আরেকটি তথ্যে দেখা যায়, প্রায় ৭৪% কিশোরী তার জীবনে পারিবারিক সদস্য বা অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনেক পরিবার নিরূপায় হয়ে বাল্যবিবাহ বা অনিরাপদ অভিবাসনের পথ খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত তথ্যেও দেখা যায় অনেক পরিবার বাধ্য হয়েই বাল্যবিবাহ বা অনিরাপদ অভিবাসনের আশ্রয় নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিপজ্জনকভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২% ছিলেন বাংলাদেশি। এবং এই ভয়াবহ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, সেই বছর ইতালিতে সমুদ্রপথে পৌঁছানো মোট অভিবাসীর মধ্যে বাংলাদেশী মানুষ ছিলেন ২৩%।

বর্তমানে ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া যদিও কিছুটা উন্নত হয়েছে, ফলে ২০২৩ সালে ১,২১০ জন ভুক্তভোগীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এবং আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ৪০৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। যদিও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)গুলো একই সময়ে ১০ হাজারেরও বেশি ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করেছে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান ফুটে উঠেছে।

চিহ্নিত ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় ৩৮% শিশু; আর ছেলে শিশুদের মূলত জোরপূর্বক কায়িক শ্রম ও অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত করা হয় এবং মেয়ে শিশুদের যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং যৌন হেনস্তার মতো বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে পাচার করা হয়।

ভৌগলিকভাবেই কক্সবাজার এবং উপকূলীয় জেলাগুলো মানব পাচারের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও সুপরিচিত। পাশাপাশি পাচারের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে এনে জোর করে অনিরাপদ কাজ করানো হয় বা যৌন সহিংসতার শিকার হতে বাধ্য করা হয়।  

ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনটিতে পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক ক্ষেত্রকে চিহ্নিত ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, মানবপাচার সম্পর্কিত ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে এবং বিচারাধীন মামলার জট দ্রুত সমাধান করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন পথশিশু এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের অতিরিক্ত সুরক্ষা ও সহায়তার আওতায় আনতে হবে। তৃতীয়ত, সমাধান করার যোগ্য পদক্ষেপগুলোকে অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্য এবং লিঙ্গভিত্তিক গঠন অনুসারে সাজাতে হবে, যাতে সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়। চতুর্থত, মানব পাচার সংক্রান্ত আইন ও সামগ্রিক শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতা ও ব্যবধান দূর করতে হবে। সবশেষে, এমন একটি সার্বজনীন শিশু সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেটি সকল শিশুর জন্য সমন্বিতভাবে সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।

এই ব্যবস্থাকে কমিউনিটি কেন্দ্রিক, রেফারেল ব্যবস্থা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলোর সাথে যুক্ত করতে হবে। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যায় টিকে থাকার কৌশলগুলোতে সুরক্ষা বিষয়টিকেও অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ মানবপাচার প্রতিরোধে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান নির্ভর করে গৃহিত জাতীয় নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান কমানোর ওপর। আর এ লক্ষ্যে প্রতিটি শিশুর সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে একটি শিশু-কেন্দ্রিক, সর্বজনীন সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির বিকল্প নেই।   

সূত্র: ইউনিসেফ বাংলাদেশ, স্টপিং দ্য ট্রাফিক: পালের্মো প্রটোকল গৃহীত হওয়ার ২৫ বছর পর বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচারের বিস্তার ও প্রতিরোধ (২০২৫)।

Leave a Reply