ফুলের অশ্রু: ঢাকার যৌনকর্মীদের জগৎ

ঢাকা শহরের কোলাহলপূর্ণ জনবসতিতে রয়েছে একটি গোপন জগত যেখানে নারী ও মেয়েদেরকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে যৌনকর্মের জীবিকায় নিযুক্ত করা হয়। দালালরা চাকরির সুযোগ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের পতিতাবৃত্তির ফাঁদে ফেলে এবং পরবর্তীতে তাদের হুমকি দেয়। এই যৌনকর্মীরা এমন একটি সমাজে বাস করে যেখানে টিকে থাকার জন্য তাদের ক্রমাগত স্বল্প বেতন এবং সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয় যা তাদের মৌলিক মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো কীভাবে তারা এই ব্যবসায় এলো? দালালরাই বা এত ক্ষমতাশালী কী করে হলো? সোনালী, রেশমি এবং জাহানারার জীবনের গল্পগুলোতে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা উঠে এসেছে-একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র যেখানে “ভাই” দের একটি দল এই পুরো ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজেদের লাভের জন্য এই নারীদের নিছক পণ্য হিসাবে ব্যবহার করে। ফলস্বরূপ, যৌনকর্মীদের নিজেদের উপার্জনের উপর নিয়ন্ত্রন নেই বললেই চলে এবং দালালদের ভয়ে তাদের এককালীন উপার্জন মেনে নিতে হয়।

বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ না হলেও কিছু আইন এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের শোষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘোষণা দিয়ে যৌনকর্মের জীবিকায় নিযুক্ত হতে পারে এবং সরকার-নিবন্ধিত পতিতালয়ে কাজ করতে পারে। তবে, ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকায় পতিতালয় না থাকার কারণে ভাসমান যৌনকর্মী এবং হোটেল ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যান্য অঞ্চল থেকে বড় পতিতালয় উচ্ছেদ তাদের ঝুকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

এই নারীরা প্রায়শই সুবিধাবঞ্চিত পরিবেশ থেকে এসে প্রতারণা্র স্বীকার হয়ে এই পেশায় নিযুক্ত হন। নাসিমার হৃদয় বিদারক গল্পটি একটি প্রকৃত উদাহরণ যে কীভাবে অসহায় মেয়েরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে এই ব্যবসায় লিপ্ত হয়। অসাধু দালালরা অসহায় মেয়েদের বাছাই করে তাদের আপত্তিকর ভিডিও ধারন করে যাতে মেয়েরা ওই ভিডিও ফাস হবার ভয়ে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং এভাবে এই চক্র আরো প্রভাবশালী হয়।

ঢাকার যৌনকর্মীদের দুর্দশা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে আরও বেড়েছে। গ্রাহকরা তাদের কাজের বিনিময়ে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে, তবুও যৌনকর্মীরা তাদের উপার্জনের একটি অংশই পায়, বাকি অংশ দালাল, বাড়ি বা হোটেল ভাড়াটে এবং এমনকি পুলিশও নেয়। দালাল এবং আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে যোগসূত্রের কারণে এই নির্যাতন আরো বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ভুক্তভোগীদের পক্ষে ন্যায়বিচার চাওয়া বা দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

যৌনকর্মী এবং গ্রাহকরা উভয়ই ঝুঁকিতে আছে। “ভাই গ্যাং” ভিজিটিং কার্ড দেখে গ্রাহকরা ছিনতাই এবং হুমকির সম্মুখীন হয়। যৌনকর্মীরা সহিংসতা নির্যাতন এবং সমাজের মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন হন। নিরাপদ কাজের পরিবেশের অভাব তাদের বিপথগামী হওয়া এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

যৌনকর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার (এস. আর. এইচ. আর) এবং মানবাধিকার রক্ষা করা অপরিহার্য। তাদের মর্যাদা ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে এবং নির্যাতন ও অপব্যবহার থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বেসরকারী সংস্থাগুলির সাথে একযোগে কাজ করতে হবে যাতে যেসব যৌনকর্মীরা ব্যবসা ছেড়ে দিতে চায় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং নিরাপদ থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা যায়।

অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের উপর সহিংসতা এবং জনসাধারণের নিপীরনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। দুর্বল নারীদের উপর নির্যাতন করে মুনাফা অর্জনকারী দালালদের অবশ্যই আইনের মুখোমুখি করতে হবে এবং পুলিশ বাহিনীকে অবশ্যই তাদের কার্যকলাপের প্রতি নজর রাখতে হবে।

সমস্যার জটিলতাগুলি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যৌন কাজে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আসতে পারে, তবে এই কারনে যারা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই পেশায় বাধ্য হয়ে এসেছে তাদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্ব যেনো ঢাকা পড়ে না যায় এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এসব নারীদের অধিকার ও জীবনযাপনকে সহজ করার জন্য সহানুভূতি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি বহুমুখী ব্যবস্থা নিয়ে অগ্রসর হওয়া জরুরি।

যৌনকর্মীদের জন্য সমাজে অবশ্যই বিকল্প জীবিকার সুযোগ প্রদানের চেষ্টা করতে হবে, শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে এই নারীদের একটি উন্নত জীবনের সুযোগ দিতে পারব, যেখানে সমাজের অন্ধকার কোণে তাদের আর আবদ্ধ থাকতে হবে না।

ঢাকার যৌনকর্মীদের জীবনের গল্পগুলো সমাজে নির্যাতন, অপব্যবহার এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার সমস্যা সমাধানের গুরুত্তকেই প্রকাশ করে। তাদের সংগ্রাম বোঝার মাধ্যমে আমরা সম্মিলিতভাবে একটি সহানুভূতিশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করতে পারি, যেখানে পেশা এবং পারিপার্শ্বিকতা নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মান এবং মঙ্গলের নিশ্চয়তা থাকবে। এখন সময় এসেছে কাজ করার, এই নারীদের সোচ্চার হওয়ার এবং সহযোগী হিসেবে তাদের অধিকার সমুন্নত রাখার।

সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন

 

Leave a Reply