প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়তাঃ মানবাধিকার কেন অপরিহার্য

প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার কোনো বিলাসিতা নয়, এগুলো জীবনেরই  অপরিহার্যতা। এ বছর আমরা দিনটি পালন করছি “Our Everyday Essentials’’ বা “আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্যতা” প্রতিপাদ্যকে (theme) সামনে রেখে। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার বা SRHR এর কথা চিন্তা করলে, কেননা SRHR মানবাধিকারের একটি মৌলিক স্তম্ভ, তবু বহু ক্ষেত্রেই এটি উপেক্ষিত  রয়ে যায়। 

বাংলাদেশও দিনটিকে ঘিরে মানববন্ধন, আলোচনা, সচেতনতা কর্মসূচিসহ নানান আয়োজন করছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন অধিকারভিত্তিক সংগঠন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এতে অংশ নিচ্ছে।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা. ড. মুহাম্মদ ইউনূস দিবসটি উপলক্ষে একটি বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তার বার্তায় প্রধান  উপদেষ্টা সকল নাগরিককে মানবাধিকারকে আস্থার জায়গায় গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, মর্যাদা ও বৈষম্যহীন জীবন নিশ্চিত করা আমাদের যৌথ দায়িত্ব।

১৯৪৮ সালে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR) মানবাধিকারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। পরবর্তীতে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার (ICCPR) এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার (ICESCR) বিশ্ব সম্প্রদায়ের ওপর একটি যৌথ দায়িত্ব অর্পণ করে। এই মানবাধিজকার ডকুমেন্টগুলি  স্পষ্ট করে যে প্রত্যেক মানুষ জীবন, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা ও বৈষম্যহীনতার অধিকারী এবং ফলে SRHR কোনো অতিরিক্ত সুবিধা নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকার।

এলেনর রুজভেল্ট একবার বলেছিলেন, “মানবাধিকার কোথায় শুরু হয়? ঘরের খুব কাছে, এতটাই কাছে যে কোনো মানচিত্রে এর চিহ্ন দেখা যায় না। অথচ সেটাই মানুষের নিজের পৃথিবী।” এই পৃথিবী টিকে থাকে আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর, আমাদের শরীর, স্বাস্থ্য এবং জীবনকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার ওপর।

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার আজও হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক তথ্যমতে, প্রজননক্ষম বয়সী প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন মানুষ যথাযথ যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সেবায় বৈষম্যের শিকার। প্রতি বছর প্রায় ২.৫ কোটি অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটে, নতুন করে ২০ লাখ মানুষ HIV এ আক্রান্ত হয় এবং বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন নারীর একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতা (Intimate Partner Violence)  বা যৌন সহিংসতার শিকার হন।

বাংলাদেশেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের Violence Against Women জরিপ অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৭৬ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে অন্তত একধরনের IPV-এর  শিকার হয়েছেন। শুধু গত এক বছরেই ৪৯ শতাংশ নারী নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ থেকে শুরু করে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার মতো নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

ঢাকার কিশোর-কিশোরীদের ওপর করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, SRHR বিষয়ে তাদের জ্ঞান, স্বাচ্ছন্দ্য এবং চর্চার মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান আছে। ৮৪.১ শতাংশ কিশোর-কিশোরী SRHR শিক্ষা সমর্থন করলেও মাত্র ৫১.৪ শতাংশ এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

দুঃখজনকভাবে মানবাধিকার অনেক সময় আমলাতন্ত্র , গ্ল্যামার এবং রাজনৈতিক কূটনীতির আড়ালে চাপা পড়ে যায়। যখন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে আরেকটি অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাব (Non-binding Resolution) পাস হয়, যখন আমরা আরেকটি বার্ষিক রিপোর্ট লিখি, যখন আলোচনা, বিতর্ক ও কূটনীতির বেড়াজালে  ঘুরপাক খায়, তখনই কোথাও না কোথাও  আরেকটি  জীবন হারিয়ে যায় এবং তাদের অধিকার গভীরভাবে লঙ্ঘিত হয়।

এবারের থিম যেমনটা বলছে “Our Everyday Essentials’’, ঠিক একইভাবে আমাদের প্রতিশ্রুতি হোক মানবাধিকারকে সত্যিকার অর্থে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করা।

এবং তাই, শেয়ার-নেট বাংলাদেশ সবাইকে  জানায় অর্থবহ, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও আশায় ভরা মানবাধিকার দিবসের শুভেচ্ছা। মনে রাখি, প্রকৃত মানবাধিকার শুরু হয় অল্প পরিসরে, আমাদের ঘরে, ক্লিনিকে, সমাজে এবং প্রতিটি মানুষ, পৃথিবীর যেকোনো স্থানে, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারী।

সূত্র:

১. ঢাকা ট্রিবিউন
২) ইউএনএফপিএ
৩) ২০২৪ নারী নিপীড়ন জরিপ
৪) জাতিসংঘ

 

Leave a Reply