পরিবর্তনের নতুন কান্ডারী – ফার্মাসিস্ট!: ফার্মাসিস্টদের হাত ধরে প্রজনন স্বাস্থ্য চর্চায় আসছে বিপ্লব

বগুড়ার ফার্মাসিস্ট সুলতান মাহমুদ বলেন, “এই প্রশিক্ষণের আগে আমি জরুরী গর্ভনিরোধক পিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতাম, কিন্তু পুরোপুরি বুঝতাম না।” “আমি এটি আর দশটা সাধারণ ওষুধের মতোই বিক্রি করতাম।” সুলতানের এই মন্তব্যে বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানের অভাবকে প্রকটভাবে তুলে ধরে। UNFPA-সমর্থিত একটি প্রকল্পের অধীনে বগুড়া এবং বাগেরহাটের ৫৩৬ জনেরও বেশি ফার্মাসিস্টকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সমস্যাটি মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

যে দেশে স্বাস্থ্য সুবিধার সীমিত সুবিধার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসিগুলো প্রায়ই স্বাস্থ্যসেবার জন্য যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়, সেখানে দায়িত্বশীল কাউকে যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অনুশীলনগুলো সম্পর্কে জানার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। তাই এই সমস্যা নিরসনে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি), “শহুরে এলাকায় অবস্থিত ফার্মেসীগুলিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার তথ্য ও পরিষেবাগুলির পরিচিতি” শীর্ষক একটি প্রকল্প চালু করেছে।

এই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ফার্মাসিস্টদের সঠিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়া, অ্যান্টিবায়োটিকের নিরাপদ বিতরণ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে রোগীদেরকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রেফার করা।

বাগেরহাটের অশোক কুমারের মতো ফার্মাসিস্টরা প্রশিক্ষণকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করেছেন। “আগে, আমি বুঝতাম না যে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে উল্লিখিত সময়কালের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত কিনা, এমনকি যদি তারা প্রথম কয়েক ডোজেই ভাল বোধ করতে শুরু করে,” তিনি বলেছেন। প্রশিক্ষণটি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স-এর বিপদ এবং প্রেসক্রিপশন নির্দেশিকা অনুসরণ করার গুরুত্বের উপর ধারণা দেয়ায় এখন তিনি তার পদ্ধতির পরিবর্তন করেছেন। “এখন আমি জানি কিভাবে তাদের সঠিকভাবে উপদেশ দিতে হয়। আমি আর কখনো প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিই না, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের!”

এই প্রকল্প শুধু জ্ঞান প্রদানের জন্য নয়; বরং এটি জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতির সাথে সম্পর্কিত। বগুড়ার মোঃ শওকত আলীর জন্য, যিনি ৩৫ বছর ধরে একটি ফার্মেসি চালাচ্ছেন, এই প্রশিক্ষণটি মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে তার চোখ খুলে দিয়েছে। “প্রশিক্ষণের সময়, আমি গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে শিখেছি, যা নির্দেশ করতে পারে যে একজন মহিলার গর্ভাবস্থায় কোন জটিলতা আছে বা হতে পারে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। “আমি এখন আমার গর্ভবতী নারী বা তাদের অভিভাবকদের কাছে গর্ভকালীন সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি এবং তাদের প্রসবপূর্ব যত্ন ও পরিষেবার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে পারি।”

প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিশ্চিত করার জন্য, UNFPA অংশগ্রহণকারী ফার্মেসিগুলোতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ পরিদর্শন পরিচালনা করতে CIPRB-কে সহায়তা করে। এই পরিদর্শনগুলি প্রশিক্ষণ নির্দেশিকাগুলির সহজবোধ্যতা, অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক বিতরণ, কার্যকর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরামর্শ, এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য সুবিধাগুলির সাথে রেফারেল সিস্টেমের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে।

“যদি আমাদের দেশের প্রত্যেক ফার্মাসিস্টকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং জরুরী পরিস্থিতিতে তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করতে সক্ষম হবে,” মোঃ শওকত আলী বলেন। তার অনুভূতি এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে— এবং সেরূপ আশার আলো জাগায় যে ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমেই তাদের নিজ নিজ এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসা সম্ভব।

সুলতান মাহমুদ, অশোক কুমার এবং মোঃ শওকত আলীর মতো ফার্মাসিস্টদের হাত ধরেই বাংলাদেশের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অনুশীলনের উন্নতিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গভীর প্রভাবকে তুলে ধরেছে। যেহেতু এই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্টরা তাদের সম্প্রদায়ের সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানই করছেন না বরং একটি স্বাস্থ্যকর, আরও সচেতন সমাজ গঠনেও অবদান রাখছেন।

সূত্র ও ছবি স্বত্ব – ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ

Leave a Reply