নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চাই যৌথ প্রয়াস: মাসিক সচেতনতার প্রথম ধাপ হোক কুসংস্কার ভাঙা

বাংলাদেশে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এখনো সামাজিক ট্যাবুর বাঁধায় আটকে আছে। মাসিক, যা নারীর জীবনে একটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত প্রক্রিয়া, সেটিও এখনো গোপন-আড়ালেই থাকে বেশির ভাগ পরিবারে। তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ নারী এখনো মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। অনেকেরই আশ্রয় হয় পুরনো কাপড়, তুলা কিংবা রাসায়নিক সুগন্ধিযুক্ত নিম্নমানের পণ্যের ওপর, যা তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে মাসিককে আর ‘লজ্জার বিষয়’ হিসেবে নয়, স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্প্রতি একটি গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এই সংকটের গভীরতা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, মাসিক নিয়ে চুপ থাকলে চলবে না, চাই পারিবারিক-সামাজিক ও নীতিগত পরিবর্তন। স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রজনন স্বাস্থ্য থাকলেও, তা কার্যকরভাবে শেখানো হয় না। আর পরিবারে মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপের পরিবেশ তো বহুক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দরিদ্র পরিবারে কিশোরীদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ প্যাড ব্যবহার করেন। এখানেই দৃশ্যমান হয় আয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকার কতটা জড়িত। স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য একটি বড় বাধা। ফলে প্যাড ব্যবহারের অভাব শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলছাত্রীদের একটি বড় অংশ মাসিকের সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকে, তৈরি পোশাক খাতেও দেখা যায় অনুপস্থিতির হার বেশি। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির এই দ্বৈত সমস্যা অবহেলা করার সময় নেই।

গবেষক, চিকিৎসক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সুষ্পষ্টভাবে বলছেন—মাসিক স্বাস্থ্যবিধি কেবল নারীর স্বাস্থ্য নয়, এটি তাঁর মর্যাদার, অধিকার রক্ষার বিষয়। মাসিকের সময় নিয়মিত প্যাড পরিবর্তন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ পণ্য ব্যবহার—এসব নিয়ে যেমন সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, তেমনি চাই অবকাঠামোগত সহায়তাও। অধিকাংশ স্কুল-কলেজে নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার কিংবা প্যাড ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা।

স্যানিটারি প্যাডের দাম কমাতে করমুক্তির দাবি উঠে এসেছে আলোচনা থেকে, যা সময়োচিত। পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে প্যাড সরবরাহ করতে হবে। দরকার একটি সমন্বিত জাতীয় কর্মসূচি, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করবে।

মাসিক নিয়ে সংস্কার ভাঙতে হলে শুধু নারী নয়, পুরুষেরও ভূমিকা থাকা জরুরি। বাবা, ভাই, স্বামী—তাঁদের সচেতন ও সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে বোঝাতে হবে, মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা লুকানোর কিছু নয়। প্রতিটি স্কুলে স্বাস্থ্য কল্যাণ ক্লাব গঠন, নিয়মিত স্বাস্থ্যশিক্ষা ক্লাস ও নিরাপদ মাসিক ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো গড়ার দাবিও এখন সময়ের দাবি।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা ছড়িয়ে না দিতে পারলে আমরা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারব না। মাসিক সুরক্ষা কেবল স্বাস্থ্য ইস্যু নয়, এটি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সম্মানের সাথেও জড়িত। তাই এই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের এখনই সময়। জনগণের স্বাস্থ্য যদি সত্যিই অগ্রাধিকার পায়, তাহলে নিরাপদ মাসিক চর্চা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র – সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply