ধর্ষণ কি লিঙ্গ নিরপেক্ষ? ধর্ষণের বিচারসংক্রান্ত আইন সংশোধনে সরকারের নতুন উদ্যোগ

ধর্ষণ কি লিঙ্গ নিরপেক্ষ? নারীর মতো পুরুষও কি ধর্ষণের শিকার হতে পারে? প্রশ্নটা অদ্ভুত মনে হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণের জন্য কঠোর শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়ার পরও এ ঘৃণিত অপরাধ বেড়েই চলেছে। লালসার কারণে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী আজ অনিরাপদ। তাই ধর্ষণের বিচারসংক্রান্ত আইন সংশোধনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীর কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনা জরুরি। সেখানে ধর্ষণকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী নারী বা পুরুষ যে কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে বিচার দাবি করতে পারবেন। অর্থাৎ ধর্ষণ ও বলাৎকার একাকার হয়ে একই অপরাধের অন্তর্গত হিসেবে গণ্য হতে যাচ্ছে। ধর্ষণের এই লিঙ্গ-নিরপেক্ষ (Gender neutral) সংজ্ঞা এমন কিছু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে, যা অকল্পনীয় হতে পারে। এটি সমকামিতাকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে জেন্ডার নিউট্রালিটি বা লিঙ্গ-নিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে। তাই ধর্ষণের নতুন প্রস্তাবিত সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য নয়। এর সপক্ষে যুক্তিপূর্ণ প্রমাণ উপস্থাপন করাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা রয়েছে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায়। সেখানে ধর্ষণ বলতে কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা তার সম্মতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে কৃত যৌন সঙ্গমকে বোঝানো হয়েছে। স্পষ্টতই ধর্ষণ মামলার বাদী/ভিকটিম একজন নারী হবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলাৎকারকে কেন ধর্ষণের সঙ্গে একত্র করা প্রয়োজন হলো? কিছু মানুষের যুক্তি হলো, সমাজে পুরুষ ধর্ষণের ব্যাপকতা রয়েছে। বিশেষ করে ছেলেশিশুরা প্রায়ই বলাৎকারের শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে হরহামেশাই মাদ্রাসার দিকে অভিযোগের তীর ছোড়া হয়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, সেটা হলো বলাৎকারের শিকার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নয়, বরং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা। ধর্ষণের জন্য সম্মতি না থাকার শর্ত এখানে অকার্যকর। কেননা আঠারো বছর বয়স না হলে তার সম্মতি ধর্তব্য নয়। তাই শিশু বলাৎকারকে ধর্ষণের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।

‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ নামে এক অদ্ভুত ধর্ষণের ইস্যু ধর্ষণের নির্মমতা ও নৃশংসতাকে হালকা করে ফেলে। যথার্থই সরকার বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা সম্মতিহীন ধর্ষণ থেকে আলাদাভাবে বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে একইভাবে শিশু বলাৎকারের অন্তর্ভুক্তি ধর্ষিত নারীর অবমাননাকর অভিজ্ঞতা ও তিক্ত স্মৃতিকে গুরুত্বহীন করে দেবে। ধর্ষণ নারীত্বের চূড়ান্ত অবমাননা। এর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা বা মিশ্রণ করা যেতে পারে না।

ধর্ষণের শিকার হয় প্রধানত তরুণী বা প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যা শিশু বলাৎকারের বিপরীত। যদিও মাঝেমধ্যে শিশু ধর্ষণের খবর আমাদের বিবেককে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়, তবে শিশু ধর্ষণ সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে নয়, বরং মানব চরিত্রের নীচুতা ও হীনতার জন্যই আমাদের আলোড়িত করে তোলে। মোটকথা, ধর্ষণের বিচারে শিশু ধর্ষণ বা শিশু বলাৎকারের চেয়ে ‘ধর্ষণ’কে আলাদাভাবে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা ৯ অনুযায়ী এখন ধর্ষণের বিচার হয়ে থাকে। এ আইনে ব্যবহৃত ‘শিশু’ শব্দের ব্যাখ্যায় ছেলেশিশুও অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটি ছেলেশিশুও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে পারবে। আমাদের প্রস্তাবনা হলো, এখানে শিশু শব্দের এরূপ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা না করে, এখানে সুনির্দিষ্টভাবে শিশু বলাৎকারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

অন্যদিকে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এমন কোনো খবর আমাদের জানা নেই। এটি কেবল সমকামী গোষ্ঠীর মধ্যেই চিন্তা করা সম্ভব হতে পারে। সমকামিতা পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা অনুসারে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলাৎকারকে আনা হলে তা ৩৭৭ ধারাকে অকার্যকর করার সুযোগ তৈরি করবে। এ ধরনের আইন করা হলে সেটা হবে একটি কালারেবল লেজিস্লেশন। অর্থাৎ সরাসরি কোনো উদ্দেশ্য হাসিল না করে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সেটা অর্জন করা। আমরা জানি, জেন্ডার মতবাদ ও সমকামিতা প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে পশ্চিমাদেরর আগ্রহ ও উদ্যোগ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় এরূপ প্রশ্নসাপেক্ষ পরিবর্তন এনে তাদের হাতে শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দেওয়া উচিত হবে না।

আসলে ধর্ষণের সংজ্ঞায় এ ধরনের বিতর্কিত পরিবর্তন নিয়ে আসা, জেন্ডার মতবাদ ও সমকামিতা আন্দোলন গোষ্ঠীর কৌশল। তারা সরাসরি সমকামিতা নিষিদ্ধ না করে, ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করিয়ে তাদের অ্যাকটিভিজমের ক্ষেত্র তৈরি করে। পশ্চিমা দেশগুলো এ পথেই সমকামিতা বৈধতার পথে গেছে। সম্প্রতি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও এভাবেই ২০১৩ সালে কৃত ধর্ষণের পরিবর্তিত সংজ্ঞার ভিত্তিতে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারা বাতিল ঘোষণা করে দেয়। আদালত বলেছেন, যদি অসম্মতিতে সমলিঙ্গের যৌনতা অপরাধ হয়, তাহলে সম্মতিসহ হলেও সে ক্ষেত্রে কীভাবে অপরাধ হতে পারে? এটাতো স্ববিরোধী। ধর্ষণের লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সংজ্ঞা গৃহীত হলে বাংলাদেশেও একই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

প্রত্যেক আইনের একটা নৈতিক ও আদর্শিক বয়ান থাকে। ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বয়ান আরও বেশি প্রমিনেন্ট। রাষ্ট্র কেমন সমাজ ও নৈতিকতা চায়, সেটা ওই রাষ্ট্রের ফৌজদারি আইন তথা অপরাধীকরণ ও বৈধকরণ (ক্রিমিনালাইজেশন ও ডিক্রিমিনালিকেশন) থেকেই বোঝা যায়। ধর্ষণ ও বলাৎকারকে ধর্ষণের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার নৈতিক ও আদর্শিক বয়ান কী, তা আমাদের কাছে মোটেই পরিষ্কার নয়।

ধর্ষণের প্রমাণ ও বলাৎকারের প্রমাণ একরকম নয়। বিচারের ক্ষেত্রে এ দুটি অপরাধকে একই সংজ্ঞার আওতায় বিচার করা সমস্যাসংকুল হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া, যেখানে নারী ধর্ষণ নিয়ে পুরো সমাজ সোচ্চার, সেখানে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়াসংক্রান্ত আইন সংস্কার করতে গিয়ে কেন তার মধ্যে বলাৎকারকে টেনে আনা হচ্ছে, সেটা বোধগম্য নয়। অতএব, ধর্ষণ লিঙ্গ নিরপেক্ষ কোনো অপরাধ নয়। বরং নারীর বিরুদ্ধে, নারীত্বের বিরুদ্ধে এক ভয়ানক, নৃশংস অপরাধ হলো ধর্ষণ। অন্যদিকে, লিঙ্গ-নিরপেক্ষতা আজ একটি মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এই তথাকথিত জেন্ডার পরিচয়বাদ মানুষকে নতুনভাবে নতুন পরিচয়ে আবদ্ধ করে ফেলছে। নিকৃষ্ট ট্রান্সজেন্ডারবাদ তার একটি নমুনা মাত্র। মানুষের যৌন সম্পর্কেও আমূল পরিবর্তন এনে সমকামিতাকে বৈধ ও স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় জেন্ডারমতবাদীরা। ‘বিবাহ নয়, যৌন সম্পর্কের ভিত্তি হবে কেবল সম্মতি’—এই হলো এ মতবাদের সারকথা। ফলে বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝেও ধর্ষণ হতে পারে যদি সম্মতি না থাকে। অন্যদিকে, সম্মতি থাকলেই অবিবাহিত নারী-পুরুষ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। জেন্ডার নিউট্রাল দর্শন এ সম্মতিবাদকে (কনসেন্টিজম) সমলিঙ্গের যৌনসম্পর্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণের মাঝে বলাৎকারকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে জেন্ডার মতবাদ ও সমকামিতা প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। তাই এ উদ্যোগ থেকে সরে আসতে হবে।

ফৌজদারি আইনে সংজ্ঞায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ না হলে তো অনেক অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের দরজা খুলে দিতে পারে। এ বিবেচনায়, উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আমরা সুনির্দিষ্ট তিনটি প্রস্তাব রাখছি—এক. ধর্ষণকে নারীর বিরুদ্ধে একটি স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ক্রিমিনালাইজ করতে হবে, চাই সে নারী শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক হোক না কেন। দুই. শিশু বলাৎকারকে আলাদাভাবে শাস্তিযোগ্য করতে হবে। শিশু বলতে ছেলে ও মেয়ে উভয়কে বোঝায়, এরূপ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ব্যাখ্যার আশ্রয় নেওয়া বন্ধ করতে হবে। তিন. জেন্ডার ও সমকামিতা মতবাদ সম্পর্কে সরকারের পলিসি স্পষ্ট করতে হবে। জেন্ডার শব্দের ব্যবহার বন্ধ করে সেক্স ব্যবহার করতে হবে। আমাদের প্রস্তাব হলো, লিঙ্গ বলতে শুধু নারী ও পুরুষ এবং যৌন সম্পর্ক কেবল বিবাহিত নারী-পুরুষের মাঝেই আইনগতভাবে স্বীকৃত, তা ঘোষিত পলিসি হতে হবে। সমকামিতা বৈধকরণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের অপচেষ্টার সঙ্গে সরকারের সম্পর্কহীনতা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে।

মূল নিবন্ধক:
ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন—সহযোগী অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
মোনায়েম খান—লেকচারার, আইন বিভাগ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

সূত্র – কালবেলা

Leave a Reply