ঢাকায় ৫,০০০-এর বেশি কন্যাশিশু বাণিজ্যিক যৌন শোষণের শিকার: গবেষণার চিত্র

দারিদ্র্য ও প্রতারণার শিকার হয়ে পতিতালয় ও এই পথে আসা শিশুদের সপ্তাহে গড়ে ২৪ জনেরও বেশি নির্যাতনকারীর মুখোমুখি হতে হয়!

বাংলাদেশে শিশুদের বাণিজ্যিক যৌন শোষণ বা Commercial sexual exploitation of children (CSEC)-এর ভয়াবহতা কতটা ব্যাপক, সেই উদ্বেগজনক চিত্রই উঠে এসেছে ‘ফ্রিডম ফান্ড’ এবং ‘পপুলেশন কাউন্সিল’ কর্তৃক প্রকাশিত এক বৃহৎ গবেষণায়। “Through Her Eyes” শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় নারী যৌন কর্মীদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন (প্রায় ২২ শতাংশ) তাদের শৈশবে এই শোষণের শিকার হয়েছেন।

শিশু বাণিজ্যিক যৌন শোষণ (CSEC) বা অর্থের বিনিময়ে শিশু যৌন নিপীড়ন বলতে বোঝায় যখন কোনো শিশু (সাধারণত ১৮ বছরের কম বয়সী) টাকা, খাদ্য, আশ্রয়, বা অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হয় বা তাকে ব্যবহার করা হয়। এটি এক ধরনের শিশু নির্যাতন এবং গুরুতর অপরাধ। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা জেলাতেই রাস্তায় থাকা প্রায় ৫,০০০ কন্যাশিশু এবং ঢাকা বিভাগের পতিতালয়গুলোতে প্রায় ৭০০ কন্যাশিশু এই বাণিজ্যিক শোষণের শিকার হচ্ছে। গবেষকরা ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী এমন ১,২৪৫ জন নারী যৌন কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যারা তাদের ১৭ বছর বা তার কম বয়সের অভিজ্ঞতাগুলো স্মরণ করেছেন।

অন্ধকার এই পথে পা রাখার প্রধান কারণ হলো জীবনের প্রতি পদে দারিদ্র্য আর টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম। জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ৮০.১ শতাংশ সরাসরি জানিয়েছেন, টাকা ও জীবনের চরম প্রয়োজনই ছিল তাদের প্রথমবার যৌন শোষণের শিকার হওয়ার মূল কারণ। এছাড়াও দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, শিক্ষাবঞ্চিত হওয়া, গ্রাম থেকে শহরে কাজের খোঁজে আসা এবং প্রতারণার শিকার হওয়া এই চক্র তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

শৈশবে যৌন শোষণের শিকার হওয়া এই শিশুদের জীবন ছিল সীমাহীন সহিংসতা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের। অর্ধেকের বেশি নারী (পতিতালয়ে ৬২.৪% এবং রাস্তায় ৫৫.৭%) জানিয়েছেন, তারা কোনো খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করলে তার ফলস্বরূপ মারধর, যৌন সহিংসতা, মানসিক নির্যাতন অথবা খাবার, পানি বা আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো গুরুতর পরিণতি ভোগ করতেন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়, এই শিশুরা সপ্তাহে গড়ে ৫.৪ দিন শোষণের শিকার হতেন। ভয়ংকর তথ্য হলো, সপ্তাহে গড়ে ২৪.৫ জন নির্যাতনকারীর মুখোমুখি হতে হতো তাদের। পতিতালয়-ভিত্তিক শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ছিল আরও বেশি, সপ্তাহে গড়ে ৪৪ জন। এই অসহনীয় মানসিক চাপ সামলাতে বা অতিরিক্ত কাজের ক্লান্তি এড়াতে অনেকে অ্যালকোহল ও ড্রাগসের আশ্রয় নিতে বাধ্য হতেন।

গবেষণাটি বলছে, যৌন শোষণকারীদের তালিকায় আছে সমাজের নানা স্তরের মানুষ। এদের মধ্যে ব্যবসায়ী, বাস বা ট্রাক চালক, পরিবহণ শ্রমিক এবং বেতনভুক্ত চাকরিজীবী রয়েছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, পতিতালয়ভিত্তিক নির্যাতনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ, প্রায় ৭১.৯ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী।

“অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিএডি)” সম্প্রতি শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, সুরক্ষা নীতিমালা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শিশুদের ক্ষমতায়িত করার মাধ্যমে সহিংসতা, নির্যাতন, শোষণ ও অবহেলা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে একটি কমিউনিটি সংলাপের আয়োজন করেন। সেখানে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, দমন-পীড়ন এবং বিশেষ করে যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টা সর্বোত্তম উপায় বলে উপস্থিত সকলে মন্তব্য করেন। 

এই প্রসঙ্গে, সংলাপে অংশগ্রহণকারী বক্তারা জোর দেন যে শিশুরা কেবল নির্যাতনের শিকার নয়, বরং সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অভিজ্ঞতা এবং সূক্ষ্মদৃষ্টি শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। তাই শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য তাদের শেখার ও বেড়ে ওঠার পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শিশু এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

শিশু বাণিজ্যিক যৌন শোষণ প্রতিরোধের জরুরি আহ্বান হিসেবে, ভয়াবহ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। গবেষকদের মতে, সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। বিশেষত, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে যৌন শোষণের শিকার হওয়া শিশুদের জন্য কার্যকর পুনর্বাসন এবং সমাজে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও, যৌন কর্মীদের, বিশেষ করে মায়েদের, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং দারিদ্র্য দূর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তাদের সন্তানরা শোষণের একই চক্রে প্রবেশ করতে বাধ্য না হয়।

উৎস: ফ্রিডম ফান্ড-এর ওয়েবসাইট

Leave a Reply