কিশোরী মাতৃত্ব ও লাগামহীন সিজারিয়ান ডেলিভারি: নারী স্বাস্থ্যের বড় ঝুঁকি!

বাল্যবিবাহ ৪৭%, কিশোরী জন্মহার বৃদ্ধি; প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়লেও সি-সেকশন ৫০% ছাড়ালো: এমআইসিএস জরিপ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফের সাম্প্রতিক মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫-এর প্রাথমিক ফল আমাদের দেশের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার (এসআরএইচআর) পরিস্থিতি নিয়ে গভীর চিন্তার জন্ম দিয়েছে। জরিপের প্রকাশিত তথ্য বলছে, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি এলেও, কিশোরী বয়সে মা হওয়া এবং প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারজনিত ঝুঁকি, এই দুটি চ্যালেঞ্জ নারী স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি করছে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের হার সামান্য কমেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও প্রায় ৪৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই হচ্ছে। বাল্যবিবাহের এই পরিসংখ্যানই অল্প বয়সে মা হওয়ার পথ তৈরি করছে। জরিপে দেখা যায়, প্রতি এক হাজার কিশোরীর মধ্যে জন্মহার ২০১৯ সালের ৮৩ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৯২-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, দেশে কিশোরী মাতৃত্বের ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

এই সমস্যাটি সমাজের দুর্বল অংশকে আরও বেশি প্রভাবিত করছে। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রতি চারজন গ্রামীণ নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন শহুরে নারীর একজন ১৮ বছর বয়সের আগেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ মা ও নবজাতক উভয়ের জন্যই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জটিলতা সৃষ্টি করে।

মাতৃস্বাস্থ্য সেবার একটি ইতিবাচক দিক হলো, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় প্রসবের হার বেড়ে ৭১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায় প্রসবের হারও বেড়েছে। তবে, উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রসবের পদ্ধতি নিয়ে। দেশে সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশনের হার লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে!

শহরাঞ্চলে এই হার আরও বেশি—৫৬ শতাংশ। সম্পদ ও শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই হার বাড়ছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, চিকিৎসার প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, অনেক ক্ষেত্রেই প্রসবকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘অস্ত্রোপচারমুখী’ করা হচ্ছে। এর ফলে মায়েদের ওপর বাড়তি শারীরিক ও আর্থিক চাপ পড়ছে।

জরিপ অনুযায়ী, গর্ভকালীন সময়ে ৯৩ শতাংশ নারী একবারের জন্য দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা নিলেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী কমপক্ষে চারটি সেবা পেয়েছেন মাত্র ৪৩ শতাংশ নারী। অর্থাৎ, প্রসূতিদের প্রয়োজনীয় নিয়মিত ফলোআপ ও পূর্ণাঙ্গ যত্নে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে।

এছাড়াও, জন্মের পর শিশুকে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করার হার কমে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা নবজাতকের পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 এমআইসিএস ২০২৫-এর এই তথ্যগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামনে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে। নারী ও কিশোরীদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে বাল্যবিবাহ রোধ, কিশোরী মাতৃত্বের ঝুঁকি কমানো এবং অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন বন্ধে জরুরি নীতিগত হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।

সর্বোপরি এমআইসিএস ২০২৫ আমাদের সামনে বাংলাদেশের শিশু ও নারীদের জীবনের একটি সুস্পষ্ট চিত্র উপস্থাপন করেছে। এটি দেখায় আমরা কতদূর এগিয়েছি এবং প্রতিটি শিশুর জন্য আরও কি ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি নীতি নির্ধারকদের জন্য সেই তথ্যভিত্তিক প্রমাণ সরবরাহ করে, যা জরুরি এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন, যাতে নীতি, বাজেট ও সেবার কেন্দ্রে শিশুদেরকে রাখা যায়। একইসঙ্গে এটি আমাদেরকে আরও জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে, কারণ এখন আমাদের হাতে শিশুদের প্রয়োজন ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আরও নির্ভুল তথ্য রয়েছে।

উৎস : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও ইউনিসেফ এর প্রেস রিলিজ।

Leave a Reply