কিছু না বলা সত্য বচন – ‘সম্ভ্রমযোদ্ধা : সেবাসদন ও একজন ডা. হালিদা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সম্ভ্রমহারা নারীদের চিকিৎসা প্রদান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সম্ভ্রমযোদ্ধা : সেবাসদন ও একজন ডা. হালিদা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। গতকাল (২০ এপ্রিল, ২০২৪) শনিবার দুপুরে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। বইটি লিখেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, ডা. হালিদা হানুম আখতার।
‘এস এইচ পি এল প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত প্রফেসর আ. হ. ম. তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সেবার কাজ অনেকে করেছেন। সবার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। ডা. হালিদার নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করছি। আশা করি, এই নির্যাতিত নারীদের যারা সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন, তারা যদি তাদের অভিজ্ঞতা লিখিতভাবে বর্ণনা করেন। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি অধ্যায় তুলে ধরা যাবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ইতিহাস যতক্ষণ লিখিত না হয়, তা ততক্ষণ স্বীকৃত হয় না। ইতিহাস লিখিত না হলে সেটি হয় মিথ। হালিদার লেখনীতে উঠে এসেছে নির্যাতিত নারীদের বর্ণনা। এটি ইতিহাসের দলিল হিসেবে কাজ করবে।
মুক্তিযুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক কারণে তারা সেই উপাধি প্রকাশ করতে পারেননি। অনেকেই জীবনের শেষ সময়ে এসেও পরিবার সমাজ থেকে যোগ্য সম্মান পায়নি। তাই তাদের অব্যক্ত কান্নার গল্প তুলে ধরে একটি অসাধারণ কাজ করেছেন বলে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মনসুর মুসা। তিনি বলেন, বইটি লিখে অন্ধকারাচ্ছন্ন, তমসাচ্ছন্ন একটি অধ্যায়ের উন্মোচন করেছেন হালিদা হানুম আখতার।
রাজধানীর ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডে একটি বাড়ির নাম ছিল ‘সাদা বাহার’। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন সেবার প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল এ বাড়িতে। সেবায় যুক্ত ছিলেন হালিদা হানুম আখতার। সেই নারীদের তিনি ‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করছেন।
‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’ শব্দটি টিকে থাকবে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। তাঁর মতে, সময়কে ধারণ করে ভাষা বা শব্দ। সম্ভ্রমযোদ্ধা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই আছে। তিনি বলেন, ‘হৃদয় থেকে বলা কথা আছে এই বইয়ে।’
হালিদা হানুম আখতার তাঁর লেখা ৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ওই সময় আরও বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল, সন্তান জন্মের পর ওই মেয়েদের অনেকেই ঘন ঘন আমাদের কাছে জানতে চাইত, তাদের বাড়ি থেকে কেউ খোঁজ নিয়েছিল কি না। বাবা, ভাই, মা—কেউ ফোন করেছিল কি না। এটা সত্যি যে যারা একবার তাদের রেখে গেছে, কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি।…মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ যখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, তখন নির্যাতিত এই নারীরা নীরবে কাঁদছে; কিছুদিন পর তাদের অনেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও ক্রমাগত নিজেদের লুকানোর পথ খুঁজছে।’
হালিদা হানুম আখতার কৃতজ্ঞতা জানান শিরিন জাহাঙ্গীরের প্রতি। শিরিন জাহাঙ্গীর ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালক। আজকের অনুষ্ঠানে শিরিন জাহাঙ্গীর বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ পুনর্বাসন সেবা শুরুর দিকে অনেকে বেশ কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। লাখ লাখ অসহায় নারীর জন্য সারা দেশে ৩০টি পুনর্বাসন কেন্দ্র করা হয়েছিল। বোর্ডের পক্ষ থেকে এই নারীদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি মাদার তেরেসাও একাধিকবার এ সেবাসদনে এসেছিলেন মা-বাবাদের ফেলে যাওয়া শিশুকে তাঁর আশ্রমে নেওয়ার জন্য।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, গণস্বাস্থ্য কমিউনিটি বেইজড ক্যানসার হাসপাতালের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার, ওয়াটার এইড দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ডা. খায়রুল ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক জান্নাতুল বাকেয়া কেকা এবং রেড অরেঞ্জ কমিউনিকেশন্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অর্ণব চক্রবর্তী।
সোর্স – প্রথম আলো