এখনই সময় নারীদের প্রতি হওয়া সহিংসতা এবং ভুল ধারণাগুলি নির্মূল করাঃ ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আহ্বান

নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা। নারী নির্যাতন রোধ শুধু নারীর বিষয় না, এটা পরিবার ও সমাজের বিষয়। নারী দিবসের এবারের থিম হলো ‘নারীর জন্য বিনিয়োগ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’। কিন্তু এই সমস্যা ব্যাপক, এবং দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড – নারীর প্রতি সহিংসতা নানাভাবে ঘটছে। আমরা প্রায়ই আলোচনা করি, যেকোনো সমাজের জন্য জেন্ডারবেজড ভায়োলেন্স একটা জটিল বিষয়। আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা উদ্‌যাপন করা হয়। সে জন্য বাল্যবিবাহসহ অনেক অপরাধকে অপরাধ মনে হয় না।

যেমন, বাল্যবিবাহের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রায় সময়েই দেখা যায় যে প্রথমে মেয়ে না করবে, এরপর চাপ প্রয়োগ করা হবে, কোনো কোনো মেয়ে রাজি হবে। কিন্তু মেয়েটার চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। তার মানসিক যন্ত্রণার কোনো মূল্য নেই। যদিও আইনগত, কাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমরা বারবার পরিবার ও সমাজের মধ্যে আটকে যাচ্ছি। পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যদি না বদলায়, তাহলে এগোতে পারব না।

দেশের প্রায় অর্ধেক নারী প্রতিনিয়ত রাস্তা, পাবলিক পরিবহন এমনকি জনসেবামূলক জায়গায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এর মূল কারণ যৌন হয়রানি ও অপর্যাপ্ত নারীবান্ধব ব্যবস্থা। বেশির ভাগ নারী মনে করেন, নিরাপত্তাহীনতা থেকে তাঁদের মুক্তি নেই। এ ছাড়াও নারীরা কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নানা রকম যৌন হয়রানির ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হন।

একশনএইড বাংলাদেশের ২০১৮ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো কমিটি হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রীরা কমিটি সম্পর্কে জানে না। নারীদের প্রতি সহিংসতার ৬৬ শতাংশ ঘটনা পারিবারিক। কিন্তু এর মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ আইনি সহায়তার জন্য আসে। এর মধ্যে নারীর পক্ষে রায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ।

ভালো পরিবেশ পেলে নারীরা সবার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। নারীকে প্রথমেই ভাবতে হবে যে তিনি মানুষ। একজন মানুষের যা অধিকার আছে, একজন নারীরও সে অধিকার আছে।কিন্তু এই অধিকারের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব যখন নারীদের পাশাপাশি সমাজের পুরুষেরাও এই অধিকারগুলো সম্পর্কে জানবেন। কিন্তু, পুরুষ তো পরের কথা, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারীরা তাদের অধিকারের ব্যাপারে অজ্ঞ। আর এই সমস্যার মূলে রয়েছে কাঠামোগত অবিচারে, যা গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও মূল্যায়নের জন্য মনিটরিং প্রক্রিয়া চালু করা প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করা দরকার। প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার, বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর পারিবারিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধ সংজ্ঞা সংশোধন প্রয়োজন।

আমরা এখনো পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিই লালন করে চলেছি, যা নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রত্যাখ্যান করে তাদের আরও ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের সবাইকেই মূল্য দিতে হচ্ছে: আমাদের সমাজে শান্তি নেই, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক নয়, আমাদের বিশ্বটা তুলনামূলক কম ন্যায়সঙ্গত।

আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের জন্য বিচারক, আইনজীবী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য নিয়মিত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাবিষয়ক আইনের ওপর প্রশিক্ষণ আয়োজন করা জরুরি। এ–সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, মামলা পরিচালনার খরচ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সময় কমিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। এখন অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি কমিটি করেছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও কাজ করে যেতে হবে। তবেই নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

Leave a Reply