আর কোন অজুহাত নয় – নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সমাজের নীরবতা ভাঙতে হবে

ধরা যাক, ১০ বছরের মরিময় (ছদ্মনাম) বস্তিতে বসবাসকারী এক ছোট্ট মেয়ে। ২০১৮ সালে এক মধ্যবয়সী লোক তাকে ধর্ষণ করে। মরিময়ের দাদি ও বস্তির নারীরা ঘটনাটি জানলেও তারা সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে চুপ থাকেন। এমনকি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হলেও তা গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই অপরাধী রেহাই পেয়ে যায় এবং নতুন শিকার খোঁজে।

বাংলাদেশে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলোতে আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতা অপরাধীদের আরও সাহসী করে তুলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪,৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র ৩,৪১৯টি মামলাই নথিভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ষণের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত ধর্ষণের সংখ্যা এই তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। রিপোর্ট না হওয়া ঘটনাগুলোর জন্য সমাজের বিচার ব্যবস্থা, আইনি দুর্বলতা এবং ভিকটিমদের সামাজিক চাপকে দায়ী করা যায়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘ভিকটিমরা পুলিশের কাছে গেলে অনেক সময় ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়া হয়। ফলে প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ পায় না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালে প্রণীত মৃত্যুদণ্ডের বিধান ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা ও বিচারে একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। আইন গবেষক তাকবীর হুদা উল্লেখ করেন, বিচারকরা এখন কেবল যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে একটি বেছে নিতে বাধ্য হন। এতে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয় এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার কমে যায়।

শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার সবচেয়ে বড় শিকার। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ২,৮৬২টি শিশুর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ৪৭ শতাংশ ভিকটিমের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৮ বছর। শিশু অধিকারকর্মীরা বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে সচেতনতা কম এবং প্রতিবাদ করার ক্ষমতাহীনতার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা তাদের শিকার বানায়।

নারী অধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, ‘নারীরা আদালতে দীর্ঘমেয়াদী ঝামেলার মুখোমুখি হয়, যা তাদের জন্য আর্থিকভাবে ও মানসিকভাবে কষ্টকর। ফলে অনেকেই মামলা করার সাহস পায় না।’

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিশেষজ্ঞরা রাষ্ট্রের বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন। শিশু অধিকার সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ এর নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, ‘নীরবতার সংস্কৃতি পরিবারে যৌন নির্যাতনকে বাড়িয়ে তোলে।’

এই বারের “সিক্সটিন ডেজ অব অ্যাক্টিভিজম”এর মূল প্রতিপাদ্য, “কোনো অজুহাত নয়,” যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃঢ় অঙ্গীকারকেই ব্যক্ত করে। তাই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও যৌন শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিটি স্কুলে যৌন সচেতনতা ও আত্মরক্ষার পাঠ বাধ্যতামূলক করা উচিত। দেশজুড়ে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষায় এক মুহূর্তের জন্যও আর কোনো অজুহাত গ্রাহ্য করা হবে না।

সূত্র – ডেইলি স্টার

Leave a Reply