নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য কি প্রসবপূর্ব শিক্ষা সত্যিই প্রয়োজনীয়?

বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মাতৃমৃত্যু একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ২০১৭ সালে প্রজনন বয়সের ২,৯৫,০০০ জন নারী মারা গেছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৯৯% মাতৃমৃত্যু অনুন্নত দেশগুলিতে পাওয়া গিয়েছিল। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র অনুমান বলে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতি ১,০০,০০০ জনের ডেলিভারির মধ্যে ৭০ জনের মাতৃমৃত্যু হওয়ার ঝুঁকি আছে।

গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের বিষয়ে আমাদের মাঝে সঠিক মূল্যায়নের অভাব রয়েছে। যখন একজন মহিলা গর্ভধারণ করেন, তখন আমরা আশা করি যে সে তার পারিপার্শ্বিক অন্যান্য নারীদের কাছ থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবে। আগে যখন যৌথ পরিবার প্রথা ছিল, তখন এমনটা হতে পারত। কিন্তু বর্তমানের একক পারিবারিক পরিস্থিতিতে, আরেকজনের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। ডাক্তার-বনাম-রোগীর অনুপাত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটসহ অন্যান্য বিষয়ের কারণে স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদানকারীরা সীমিত আকারে সহায়তা প্রদান করতে সক্ষম। এমন অবস্থায় একজন মায়ের একমাত্র অবশিষ্ট উপায় থাকে গর্ভাবস্থার বিকাশের সাথে সাথে কী প্রয়োজন তা খুঁজে বের করা।

প্রসবের পরপরই প্রসবকালীন যত্ন (ANC) এবং ডেলিভারি পরিষেবাগুলি ব্যবহার করা মায়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে এবং সর্বোত্তম উপায়ে নবজাতকদের জন্ম নিশ্চিত করতে পারে। গর্ভবতী মহিলারা যখন ক্লিনিকাল নির্দেশিকা অনুসারে প্রয়োজনীয় সংস্থানসহ যোগ্য পেশাদারদের দ্বারা প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহার করেন, তখন বেশিরভাগ গর্ভকালীন সমস্যা যা গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুতে পরিণত হয় তা এড়ানো যেতে পারে।

প্রসবপূর্ব পরিচর্যা (ANC) পরিষেবাগুলি ব্যবহার করলে গর্ভকালীন সমস্যাগুলির প্রাথমিক সতর্কতা সংকেত সনাক্তকরণ, জরুরী যত্নে মহিলাদের রেফারেল এবং গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন গুরুতর সমস্যাগুলির ব্যবস্থাপনাকে সহজ করে৷ যদিও বেশ কয়েকটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার উন্নতিতে সাফল্য অর্জন করেছে, তা সত্ত্বেও মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আরও উন্নয়ন ও প্রচার প্রয়োজন।

প্রসবপূর্ব প্রশিক্ষণের ক্লাসগুলি গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুতি, গর্ভাবস্থায় পুষ্টি এবং ব্যায়াম, প্রসবের লক্ষণগুলি জানা, কখন চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে তা জানা, প্রসব কীভাবে অগ্রসর হয় তা জানা, গর্ভে বাচ্চার অবস্থান সম্পর্কে জানা, প্রসবোত্তর যত্ন, একটি নবজাতকের যত্ন, নবজাতককে শান্ত করার কৌশলসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে।

লোক যাই বলুক, প্রসবপূর্ব প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র গর্ভবতী মহিলাদের জন্য নয়। বরঞ্চ, গর্ভবতী মহিলার স্ত্রী, বন্ধু, মা বা বোনসহ যারাই সন্তান নেয়ার কথা ভাবছেন তারাই এই সেশনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন৷ অতএব, একটি নির্বিঘ্ন জন্মের প্রস্তুতির জন্য এই ৪০-সপ্তাহের কঠিন যাত্রার জন্য প্রস্তুতিমূলক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। প্রসবপূর্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সবকিছু জানা হল প্রসব-পরবর্তী অভিজ্ঞতাকে ঝুকিহীন করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। একজন মহিলার জন্য একটি নিরাপদ প্রসবের অভিজ্ঞতা তার সমগ্র মাতৃত্বের জন্য খুবই মূল্যবান।

মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচীগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবহার বাড়ানো এবং মাতৃত্বকালীন সুস্বাস্থ্যের প্রচারের জন্য দরিদ্র আর্থ-সামাজিক অবস্থার অল্পবয়সী, গর্ভবতী মহিলাদের বা স্বল্প শিক্ষিত স্বামীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। অধিক খরচ হয়া সত্ত্বেও প্রসবের জন্য জনগণ কেন পাবলিক থেকে প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এ নিয়ে বিস্তারিত ও প্রাসঙ্গিক গবেষণা হয়া খুবই জরুরী। এবং সেই গবেষণার আলোকে নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতের সকলকে একত্রিত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে প্রান্তিক জনগণের মাঝে ANC পরিষেবা সম্পর্কে যে অজ্ঞতা আছে তা দূর করার জন্য মাঠ পর্যায়ে ব্যপক প্রচারণা চালানো উচিত। মাতৃত্বকালীন যত্নের খরচ কমিয়ে বা বীমা ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস করা যেতে পারে।

Leave a Reply